আজাদী পথ দেখায়, অন্যরা তা অনুসরণ করে

ববি বড়ুয়া | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

আমার ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলে প্রথম শ্রেণীতে উঠে সবে ‘অ -আ ‘ পড়তে ও লিখতে শিখেছে। এক শুক্রবার স্কুল ছুটির দিনেসকালে নাস্তার টেবিলে বড়দের পড়া শেষ করে রাখা পত্রিকায় ছোট ছোট আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে বলে , “মাম্মা ‘আ ‘, মাম্মা’আ’। কী ভালো লেগেছে শুনে আমার ছেলে ‘দৈনিক আজাদী’ এর ‘আ’ পড়তে পারছে । শুনেছি আমার ছেলেবেলাতেও ঠিক এমনি করেই একটি একটি করে শব্দ পড়তে শেখাতেন আমার বাপী।
ভোরে উঠেই নাস্তার টেবিলে একজন একজন করে আমার শ্বশুর মশাই, এরপর শাশুড়ি মা কিংবা ননদের পালা করে চলতো দৈনিক আজাদী তে চোখ রাখার পর্ব।এখনো আমার শ্বশুর মশাই বেঁচে না থাকলেও চলে পালাক্রমে শাশুড়ি মা, বর, আমি এরপরআমার মেয়ের পত্রিকায় চোখ বুলানোর পরিক্রমা। এখনো আমার বাপীর অফিসে, মায়ের বাসায়, ননদের ঘরে, আমার কর্মসংস্থানে সহকর্মীদের হাতে হাতে যে যার মতো চোখ রাখে এই আজাদীর পাতায়। শুধু যে সকালের নাস্তার টেবিলে পড়া তাই-ই নয়। এটি আবার ব্যাবহৃত হয় মাছ ভাজা, পাকোড়া ভাজা, কিংবা ঘর পাল্টাতে কাঁচের জিনিসের সুকক্ষা কবচ সহ নানাবিধগৃহস্থালি কাজে। ঘরের আনাচে কানাচে আজাদী থাকবে এটিই চট্টলবাসীর ধর্ম কিংবা বলা যেতে পারে বংশপরম্পরায় ঐতিহ্য। চট্টলবাসী আর আজাদী যেন এক সুতোয় গাঁথা নকশীকাঁথার মাঠ। এর সাথে জড়িয়ে আছে যেন চট্টলার মানুষের অঘোষিত প্রেম। দিনের প্রথম প্রহরে এর শরীরে হাত না বোলালে যেন সকালটা শুরু হতে চায় না।
ছেলেবেলা থেকে কালো কালো অক্ষরে ছাপানো পাতায় হাতের পরশ বুলিয়ে ভাবতাম , আহা কী অদ্ভুত সুন্দর। এখানে যাঁদেরলেখা ছাপা হয় তাঁদের কতোই না পড়াশোনা , জানার পরিধি কতোই না বিস্তৃত! প্রথম যেদিন ফেইসবুকে সুখেদুখে তে আমারএকটি ছোট্ট লেখা ছাপা হয় দিনে কতোবার তাতে হাত বুলিয়ে দেখেছি। মনে মনে নিজেকে নিয়ে গর্ব করেছি। ভেবেছি আমারলেখা ছাপা হয়েছে। কতোই না সৌভাগ্যবান আমি! লেখাটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলে মানুষের মন্তব্যের জোয়ারে ভেসেছি। এই পর্বে লেখা ছাপা হলে লোভ বাড়তে শুরু করে। ভাবি ঈশ্‌ যদি উপসম্পাদকীয় তে যদি আমার একটি লেখাছাপা হতো! একটি সময় উপসম্পাদকীয়তে লেখা ছাপা শুরু হয়। মানুষ পড়ে। এখন বাইরে বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা হলে বলে, ‘আজাদীতে ছাপানো আপনার লেখাগুলো পড়ি। খুব ভালো লাগে আপনার লেখা “। তখন সেই ভালো লাগার অনুভূতি হয়তোএখন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। গতবছর মুজিব বর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে বিশেষ সংখ্যায় রঙিনপাতায় লেখা ছাপা হয়। আজো মনে পড়ে সেই পাতায় হাত বুলিয়ে কেঁদেছিলাম। সেই অশ্রু ছিল আবেগের; তবে তা দুঃখের না, সুখের অশ্রু। আমার পিতাকে ফোন করে বলেছিলাম, বাপী দেখেন, আপনার মেয়ের লেখা রঙিন পাতায় বিশেষ সংখ্যায় ছাপাহয়েছে। একইভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম আজাদীর সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ মহোদয়কেও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। আসলে দৈনিক আজাদীকে যদি শুধু মাত্র একটা পত্রিকা হিসেবে গণ্য হয়, তবে তা নেহায়াতই কম বলা হবে। এই পত্রিকা সৃষ্টি করেছে হাজার হাজার লেখক, সাহিত্যিক। মানুষের মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা লেখক সত্তাকে জাগিয়ে, তার ভেতরে থাকা শুদ্ধ মানুষ টিকে বের করে এনেছে, করেছে পবিত্র।
এতো ছিল একজন লেখা পাগল মানুষের নেহায়াতই মনের আল্পনা। ছিল উপসম্পাদকীয় পাতার গল্প। কিন্তু যদি সম্পূর্ণ পত্রিকারকথা আসে তবে বলতে হয় দেশের যেকোন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হোক বা দেশের যেকো অরাজক পরিস্থিতি হোক এখানে সঠিক তথ্য সম্বলিত সংবাদ ছাড়া এড়িয়ে গিয়ে, কিংবা রাখঢাক করে সংবাদ প্রকাশের সংবাদ অন্তত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পারিপার্শ্বিক যেকোন খবর ছাপানো হয়েছে তা বরাবরই বস্তুনিষ্ঠতা অক্ষত রেখেই। কখনো সংবাদ প্রকাশে আপোষ করতে দেখা যায়নি। আর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়ার আশাতেই আপামর জনসাধারণ ভোরের আলো ফুটতেই মুখিয়ে থাকে তাদের আস্থার জায়গা, তাদের প্রিয় দৈনিক আজাদী হাতে পাওয়ার। হয়তো এই কারনেই এই পত্রিকাটি দেশের অনন্য একটি পত্রিকা হিসেবে নিজের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। আজাদীর সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ মহোদয়ের লেখায় জানলাম, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘নিরীক্ষা’ সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৯৯ সংখ্যায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করে। যে জন্য একজন পাঠক হিসেবেও প্রেস ইনস্টিটিউটকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়, কেননা তাঁরা আজাদীকে এই স্বীকৃতিটা দিতে কার্পণ্য করেননি।
আমরা জানি, দৈনিক আজাদীকে বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। কিন্তু একটু ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই দৈনিকের জন্ম বাংলাদেশের জন্মের ১১ বছর ৩ মাস ১১ দিন আগে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় লাভের পর ১৭ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী। সেই থেকে আজ অব্দি আজাদী চট্টগ্রামের মানুষের কাছে ভালোবাসার অনন্য আবাসস্থল হিসাবে মনে জায়গা জুড়ে আছে। দেশের মানুষের যেখানে ছাপানো কাগজ হাতে নিয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়, সেখানে চট্টগ্রামের মানুষ যারা দেশের বাইরে অবস্থান করছে তারা অনলাইনের মাধ্যমে তাদের প্রিয় পত্রিকায় চোখ রাখার সুযোগ হয়। দৈনিক আজাদীর অনলাইন সুবিধা আজাদী প্রেমী প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে দেশের খবরের স্বাদ গ্রহণেরও অনন্য সুযোগ বলা চলে। যার কারণে অন্য পত্রিকার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে নিজের দূরদর্শিতার পরিচয়ও পাওয়া যায়।
দৈনিক আজাদীর পাঠক এই দৈনিকে খুব সহজেই তাদের মনের খোরাক গ্রহণ করে দেশের প্রতিদিনের নানা সংবাদ, সাহিত্য পাতা, উপসম্পাদকীয়তে নানা প্রবন্ধ কিংবা কলাম হতে, খেলাধুলার খবর কিংবা ফেসবুকে সুখে-দুখের মতো যুগোপযোগী নানা আয়োজন হতে। তবে স্পষ্ট বলতে বা দ্বিধা হীনভাবে বলতে গেলে বলতে হয় দেশের অন্যান্য পত্রিকার তুলনায় আজাদী সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সমালোচনা-এটি আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। হয়তো এই সংবাদপত্রটির এই সীমাবদ্ধতাতেই তার সাফল্যের জয়গান রচিত। উল্লেখ্য, আজাদীর নীতিনির্ধারকেরা কখনো এটিকে জাতীয় দৈনিকের চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেননি, বরং একটি অঞ্চলের মানুষের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরে এর প্রতিকারের জন্য সোচ্চার হয়েছে। এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি স্থানীয় ছোটখাটো সভা-সেমিনার, অনুষ্ঠানাদির সংবাদও এতে ছাপা হয়।এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষ এটিকে নিজেদের কাগজ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আঞ্চলিকতা প্রীতির কথা ওঠায় মনে পড়ছে বেশ আগে সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘মনে পড়ে, চট্টগ্রামের মানুষ ড. ইউনূস যেদিন নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন, তার পরদিন আজাদী প্রধান শিরোনাম করেছিল, ‘আঁরার ইউনূস নোবেল পাইয়ে।’ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু যেদিন চট্টগ্রামে আঘাত হেনেছিল তার আগের দিন আজাদীর সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘রোয়ানু আইয়ের’।” এভাবে চট্টগ্রামের গৌরবের সঙ্গে যেমন এ অঞ্চলের মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে আজাদী, আবার শঙ্কা ও দুর্দিনের সময় আপনজনের মতো তাদের সতর্ক করার দায়িত্ব নিয়েছে।এই আঞ্চলিকতার টানেই এই কাগজটি চট্টগ্রামের মানুষের মনে ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছে।
শুধু তাই-ই না, তাঁর লেখায় জেনেছিলাম স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে এই পত্রিকার অনন্য সাহসী ভুমিকার কথা। জেনেছিলাম, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার তাদের প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে এদেশের সব দৈনিক পত্রিকায় কিছু প্রবন্ধ সরবরাহ করে তা প্রকাশ করতে বাধ্য করে। দৈনিক আজাদী তা প্রকাশ করলেও পরদিন তার জবাবে বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রবন্ধ ছাপে। এ কারণে তখন সরকারি গোয়েন্দা রিপোর্টে আজাদী সম্পর্কে বলা হয়, A Bengali Daily from Chittagong having leaning towards opposition.
আজকেই এই সময়ে এসে, এই পত্রিকার নিয়মিত পাঠক হিসেবে কিংবা বলা যায় এর পাতায় নিজের লেখার সুযোগ হয় বলেই এই দৈনিক আজাদী আমার, আমাদের ভালোবাসা ও গৌরবের অধ্যায় হয়ে আছে, থাকবে।তবে এতো সাফল্যের পেছনে যাঁদের অবদান,এর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক মহোদয়কে স্মরণ করছি এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করছি আন্তরিকতায়। এছাড়াও যাঁদের হাতে এই কর্মযজ্ঞের চাবিকাঠি এই পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক এম এ মালেক মহোদয় সহ পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্টরা, দিনরাত এক করে কাজ করে যাওয়া অকুতোভয়-সাহসী সাংবাদিকদের জানাই ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও অভিভাদন।
৬২ বছর পেরিয়ে ৬৩ তে পা রাখতে যাওয়া ‘দৈনিক আজাদী’র উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি। একইসাথে আশা রাখছি এটি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভালোবাসার প্রবাহমান ধারা অব্যাহত রাখবে আগামীতেও।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্য
পরবর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী : সত্যনিষ্ঠ গণমাধ্যম পথিকৃৎ