জন্মিলে একদিন মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে এটাই দুনিয়ার অমোঘ বিধান। কুরআন মজিদের একাধিক স্থানে আল্লাহ পাকের ভাষ্য-‘কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মওত’, অর্থাৎ প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু কিছু কৃতী মহৎ মানুষের মৃত্যুতে কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন একজন কৃতী–গুণী মানুষই হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর কর্মাধ্যক্ষ মঈনুল আলম বাদল। তাঁর বয়স খুব বেশি হয়নি। মাত্র ৬৫ বছরের জীবন। ১৯৯১ সন থেকে দৈনিক আজাদী অফিসে আমার যাওয়া আসা। সেই থেকে আমি তাঁকে আজাদীর কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে দেখে আসছি। হয়তো আরো আগেই তিনি আজাদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। টানা কয়েক দশক ধরে আজাদীর কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে থেকে তিনি নিজ কর্মগুণেই ‘আজাদী অন্তঃপ্রাণ’ হয়ে উঠেন। একজন মানুষ স্বীয় কাজের প্রতি কতোটা নিষ্ঠাবান, ব্রতী ও দায়িত্ববান হতে পারেন তার বড় দৃষ্টান্ত মঈনুল আলম বাদল। একজন স্বাভাবিক কর্মক্ষম মানুষ সাধারণত ৬/৮/১০ ঘণ্টা কিংবা বড় জোর ১২ ঘণ্টা হয়তো নিজ কর্মস্থলে সময় দেন। কিন্তু বাদল সাহেব আজাদীর জন্য দিনে–রাতে কতো ঘণ্টা শ্রম–সময় দিতেন তা তাঁকে কাছ থেকে যারা দেখেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি ২০০৫ সনের ১০ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আজ হতে প্রায় ১৯ বছর আগে দৈনিক আজাদীর সম্পাদনা সহকারী হিসেবে সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। সেই থেকে সবার প্রিয় ‘বাদল মামা’কে কাছ থেকেই দেখে আসছি। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন ভদ্র–সজ্জন প্রাণোচ্ছল ব্যক্তি হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। দৈনিক আজাদী সম্পাদক সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত জনাব এম এ মালেকের নিকটাত্মীয়ই হলেন বাদল সাহেব। আমাদের সম্পাদক মহোদয়ের জ্যেষ্ঠপুত্র আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক জনাব ওয়াহিদ মালেক বাদল সাহেবকে ‘বাদল মামা’ বলে ডাকতেন। তাই অনেকেই তাঁকে ‘বাদল মামা’ হিসেবে সম্বোধন করতো। ৬৪ বছরের দৈনিক আজাদীর এই সুদৃঢ় পথচলার প্রায় অর্ধেক সময় আজাদীতে অতিবাহিত করেন এই কর্মবীর। প্রতিদিন রাত ৮টায় তিনি আজাদী অফিসে আসতেন। প্রায় তিন ঘণ্টা এখানে অবস্থান করে রাত ১১টার দিকে চেরাগী পাহাড় মোড়ের আজাদী টাউয়ারের বাসায় যেতেন। রাতের খাবার সেরে সামান্য বিশ্রাম নিতেন। তবে তাঁর মন পড়ে থাকতো আজাদী অফিসে। রাত ১২টা/১টা/৩টায়ও তাঁকে সজাগ ও সক্রিয় দেখা যেতো। এমনকি গভীর রাতে ও জরুরি প্রয়োজনে সম্পাদক স্যার বা পরিচালনা সম্পাদক স্যার তাঁকে ফোন করলে ফোন ধরতেন। আজাদীর বার্তা বিভাগ, কম্পিউটার সেকশন কিংবা প্রেসের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় দিক–নির্দেশনা দিতেন তিনি। কখনো কোনো সমস্যা দেখা দিলে গভীর আন্তরিকতায় সবকিছু সামাল দিতেন। সময়ে–অসময়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কখনো একটুও উষ্মা বা বিরক্তি দেখাতেন না। আজাদী ভবনের নিচ তলার ছাপাখানার ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে খুবই আন্তরিক ছিলেন। এমনকি রাত ২টা/৩টার সময়ও তাঁকে বহুবার দেখেছি আজাদী অফিসে ও ছাপাখানায় পায়চারি করতে। প্রেসের মেশিন ঠিকঠাক আছে কি–না কিংবা স্টাফরা ঠিকমতো আসছে কিনা সবকিছুর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। আজাদীর বড়–ছোট খুঁটিনাটি সব বিষয় গভীর আন্তরিকতায় দেখভাল করতেন তিনি। প্রেসের মেশিনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে কিংবা মেশিনম্যান কেউ না এলে তখন সবচেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত–পেরেশান দেখা যেতো বাদল সাহেবকে। সকালেও তিনি ঘুমানোর সুযোগ পেতেন না। প্রতিদিন ঠিক সকাল ১০টায় আজাদীর আন্দরকিল্লাস্থ কোহিনূর প্রেসের অফিসে যেতেন। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে দিনের ১১টায় আসতেন আজাদী অফিসে। টানা দুপুর ২টা পর্যন্ত থাকতেন। দুপুরের খাবার শেষে হয়তো সামান্য বিশ্রাম নিতেন। সারা দিন আজাদীর জন্য সময় দিতেন আবার রাতে আরামের বিশ্রাম ও ঘুম বিসর্জন দিয়ে আজাদী পত্রিকার জন্য এভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। সত্যিই অসাধারণ কর্মবীর মানুষ ছিলেন তিনি।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক জনাব এম এ মালেক বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেশের বাইরে গেলেও আজাদী প্রকাশনায় কখনো বিন্দুমাত্র বিঘ্ন বা ছেদ পড়েনি। কারণ তাঁদের আস্থার মানুষ ‘বাদল সাহেব’ তো আছেন। এমন বিশ্বস্ত, দায়িত্বশীল কর্মোদ্যমী মানুষের হাতে সব জিম্মাদারি অর্পণ করে আজাদী কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ নির্ভার ও চিন্তামুক্ত থাকতেন। শুধু আজাদী পত্রিকার ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক নানা বিষয়–আশয় তিনি দেখভাল করতেন তা নয়, সম্পাদক মহোদয়ের পারিবারিক নানা বিষয়েও সময় দিতেন। ডাক পেয়ে নানা বিষয় সামাল দিতেন। সম্পাদক স্যারের নির্দেশনা মতো দ্রুত ব্যবস্থা করে দিতেন। সম্পাদক বা পরিচালনা সম্পাদক স্যারের পরামর্শ ও নির্দেশনা মতে আজাদী পত্রিকা, আজাদী পরিবার এবং সম্পাদকের ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা কাজ–কোথায় নেই বাদল সাহেবের প্রাণময় উপস্থিতি! অর্থাৎ অর্পিত দায়িত্বের বাইরেও তিনি বাড়তি প্রেসার ও চাপ সামলাতেন। হোক না তা দিনে বা গভীর রাতেও। এতে কখনো তাঁর মাঝে বিন্দুমাত্র বিরক্তি ও অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি।
১২/১৩ বছর আগের কথা। দৈনিক আজাদীর পেস্টিং বিভাগে কর্মরত রাউজানের বাসিন্দা শাহজামান সেলিমের হঠাৎ মৃত্যুর খবর শুনলাম। বন্ধুর আক্রমণে তাঁর অপমৃত্যুতে আজাদী পরিবার শোকার্ত হলো। সেদিন আমার জামালখান ঝাউতলার বাসায় অবস্থান করছিলেন আমার বাবা হালিশহর মাদ্রাসায়ে তৈয়বিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল এর সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ.)। আমি বাদল সাহেবকে বললাম, শাহজামান সেলিমের লাশ কিছুক্ষণের মধ্যে আজাদী অফিস চত্বরে আনা হবে। আপনি অনুমতি দিলে আমার বাবা তাঁর নামাজে জানাজা পড়াতে পারবেন। বাদল সাহেব বললেন, হ্যাঁ– তাই তো করা যায়। তাঁকে নিয়ে আসেন। সেদিন আমার বাবা সেলিমের নামাজে জানাজা পড়িয়েছিলেন। সম্পাদক স্যারসহ আজাদীর অনেক সাংবাদিক–স্টাফ সেদিন সেলিমের নামাজে জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। বাদল সাহেবের সম্মতির কারণে সেদিন আজাদী অফিস চত্বরে এই নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই স্মৃতি আমি এখনো ভুলিনি।
প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আজাদী ভবনে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের মৃত্যুবার্ষিকীও প্রতি বছর মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে আজাদী ভবনে পালন করা হয়ে আসছে। বছরের এই দুটি দিনে বাদল সাহেবের দায়িত্ব যেন আরো বেড়ে যায়। হুজুর ঠিক করা, নাস্তা অর্ডার ও পরিবেশন, ব্যানার তৈরি ও সাঁটানো সব কাজেই সনিষ্ঠ থাকেন বাদল সাহেব। মিলাদ মাহফিলে অতিথিদের বরণেও তিনি সজাগ থাকতেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের যারা ফুল ও নানা উপঢৌকন নিয়ে আজাদী অফিসে আসেন এর দেখভালেও থাকেন ‘বাদল মামা’। সবখানেই তাঁর সপ্রতিভ উপস্থিতি ও অগ্রণী ভূমিকা লক্ষ্য করা যেতো।
মুনিবের মৃত্যুতে তাঁর অধীনস্থ ব্যক্তিরা কাঁদেন ও আহাজারি করেন তাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন অধীনস্থ ব্যক্তির মৃত্যুতে মুনিব কাঁদেন তখন তা ব্যতিক্রম বলে মনে হয়। বাদল সাহেবের মৃত্যুর পর আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, ওয়াহিদ মালেক ও শিহাব মালেকের নীরব আহাজারি ছিল লক্ষ্য করার মতো। তাঁরা অশ্রুসিক্ত ছিলেন। যা অনেকের নজর এড়ায়নি। ৫ জানুয়ারি শুক্রবার বাদে জুমা কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদে নামাজে জানাজায় বাদল সাহেবের আত্মীয় স্বজন ছাড়াও সর্বস্তরের শত শত মানুষের উপস্থিতিই জানান দেয় বাদল সাহেবের গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক প্রভাব কতোটা। বাদল সাহেবের মতো ‘আজাদী অন্তঃপ্রাণ’ মানুষ কি আরেকজন খুঁজে পাবে আজাদী! মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু কর্মবীর মানুষেরা দুনিয়া হতে প্রস্থান করলেও সবার মণিকোঠায় চিরকাল ঠাঁই করে নেয়। এমন কৃতী গুণী মঈনুল আলম বাদলের মৃত্যুই যেন আজাদী পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর শূন্যতা আমরা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি।
লেখক : সিনিয়র সম্পাদনা সহকারী, দৈনিক আজাদী