আজও কি আমরা যৌতুক প্রথা থেকে মুক্তি পেয়েছি? আমি বলবো মোটেও না। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে বা টিভি দেখলে, ফেসবুক ঘাটলে যৌতুকের মর্মান্তিক ঘটনাগুলি, দৃশ্যগুলি মনের মাঝে ভেসে ওঠে। গভীর অনুশোচনায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়। আমার প্রশ্ন সমাজপতিরা এই গুলি নিয়ে কি ভাবে? মাঝে মাঝে নিজেদের অসহায় মনে হয়। কারণ আমরাও এই সমাজের লোক। আত্মীয় পরিবার, পরিজন নিয়ে বাস করতে হয়। তারপরও এটা কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই ঘটনাগুলি বেশি ঘটে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকদের মধ্যে, যেখানে উভয় পক্ষ গরীব। ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে যৌতুক নিয়ে বাড়াবাড়ি কম। কারণ সম্বন্ধটা হয় সমানে সমানে। তবে মধ্যবিত্তের মধ্যে এখনও চলমান আছে। যৌতুক প্রথা আদিকালেও ছিল এখনও আছে। ছেলের পক্ষ বসে থাকে বিয়েতে দেনা পাওনার কথা থাকবেই। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার প্রতি কারও এতটুকু দরদ নেই আজকের লেখাটা অনেকদিন আগের একটা ঘটনা উল্লেখ করে শুরু করতে চাই। ইতিহাস বলে তখনকার দিনে রাজা, মহারাজারা, বাদশারা মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় উপঢৌকন স্বরূপ স্বর্ণালংকার, মুদ্রা, এমনকি রাজ্য পর্যন্ত যৌতুক দিত। ধনাঢ্য, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে উপঢৌকন পাঠিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারে ইহা এখনও প্রচলন আছে। এ কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য হলো এই প্রথায় সমাজে ভীষণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আর যারা পারে না তারা বৈষম্যের শিকার হয় ও সামাজিকভাবে নিজেকে ধিক্কার দেয়। কিছু করার নেই আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এই রকম। ঘটনাটা উল্লেখ করতে গিয়ে বলতে হয়– সম্বন্ধটা হচ্ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। উভয়পক্ষের আত্মীয় স্বজন উপস্থিত। কথাবার্তা প্রায় ঠিক হতেই বর পক্ষ দাবী করে বসলেন-‘মেয়ে যখন দিচ্ছেন, বিয়াই মশায় দেনা পাওনার কথাটাও মিটিয়ে ফেলা ভালো। ছেলের বাবা বলা শুরু করলেন–নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, স্বর্ণালঙ্কার পাঁচ ভরি থেকে শুরু করে দশ ভরি, ঘর সাজানো ফার্নিচার, মটর সাইকেল ইত্যাদি ইত্যাদি। টিভি তখন ছিল না। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা অনেক ভেবে চিন্তে পঞ্চাশ হাজার টাকা, পাঁচ ভরি সোনার গহনা, বিয়ের যাবতীয় আয়োজন, বর যাত্রীদের খাওয়ানো সব ব্যাপারে রাজী হলো। অনুষ্ঠানটা হবে বাড়ির উঠানে–যেখানে পাড়াপড়শীরা আসবে, উলুধ্বনি দেবে, আনন্দ করবে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা এত কিছু দিতে রাজী হওয়া সত্ত্বেও একটা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিয়েটা ভেঙে যায়। ঘটনাটা হলো বরের মামা যৌতুকের গয়নাগুলো খাঁটি কিনা যাচাই করে দেখতে চাইলো। তাতে কনের বাবা ভীষণ অপমান বোধ করলেন। ইহাতে বর পক্ষের হীনম্মন্যতা প্রকাশ পায়। কনের পিতা বিয়ে ভেঙে দিলেন। সমাজের একমাত্র ঘৃণ্য যৌতুক প্রথার কারণে মেয়েটার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে রইলো। এটা সমাজের জন্য বিশেষ করে গরীব কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য অভিশাপ। যৌতুক প্রথা নিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপট আরও করুণ। প্রতিদিন আমাদের দেশে কোনও না কোনও এলাকায়, কোনও না কোনও পরিবারে নব বিবাহিতা থেকে শুরু করে সব বয়সের মেয়েরা যৌতুক বলির শিকার হচ্ছে। মেহেদি শুকানোর আগে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। বিয়ের পরপরই শুরু হয় স্বামী থেকে শুরু করে শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের দ্বারা শারীরিক মানসিক নির্যাতন। অজুহাত হলো যৌতুক। দরিদ্রপিতা–ভ্যানচালক, রিক্সাচালক, ডেইলী লেবার–তার শেষ সম্বলটুকু দিয়েও মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকদের খুশি করতে পারেনি। জামাই বিদেশে যেতে চায়। তার কয়েক লক্ষ টাকা দরকার। বউকে বলে, তোর বাবা থেকে টাকা এনে দাও। বিয়ের আগে কথা ছিল অমুক তমুক ‘যদি না আন তোকে মেরে ফেলা হবে।’
এইভাবে দিনের পর দিন, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চলতে থাকে। বাবা চায়ের দোকানদার জায়গা জমি কিছুই নাই, কোত্থেকে দেবে এই টাকা, একদিন খবর আসলো ‘আপনার মেয়ে ফাঁস খেয়েছে, পিতামাতা দৌড়ে গিয়ে দেখলো, মেয়ের গলায় ওড়না পেঁছানো, ফ্যানের বা বীমের সাথে লটকানো। পিতার সন্দেহ হয়, বলে উঠে ‘ আমার মেয়ে ফাঁস খায়নি, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে মেরে লটকাইয়ে রাখছে’, হায়রে অবলা নারী কত আদর করে বড় করে বিয়ে দিল। পরিণতি অকাল মৃত্যু। এ দেশে বধূ নির্যাতনের প্রকারভেদ বলে শেষ করা যাবে না। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০–৩০% বিবাহ বেশি দিন টিকে না। সেটাও যৌতুকের কারণে। যৌতুক বা পণপ্রথা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। যাদের ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে রয়েছে মা–বাপের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। অধুনা গ্রামে গঞ্জেও বিবাহ অনুষ্ঠান, টাকা থাকুক না থাকুক ক্লাবে হবে। কিছুদিন আগে গ্রাম থেকে দুইজন মহিলা খুঁজতে খুঁজতে আমার বাসায় হাজির। কাপড় চোপড় দেখে মনে হলো নিতান্ত গরীব। কেন আসছে জিজ্ঞেস করাতে বললো– মেয়ের বিয়ে কিছু সাহায্য চায়। বিয়ের অনুষ্ঠান কোথায় হবে জিজ্ঞেস করাতে বললো–ক্লাবে। বল্লাম তাতে তো লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ। তোমরা ভিক্ষে করে ক্লাবে বিয়ে দিবে? উত্তরে বল্লো–ক্লাবে বিয়ে না হলে ছেলে বিয়ে করবে না। অগত্যা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে বাহির হলো। ভেবে দেখুন তো এটা কোন সমাজ ব্যবস্থা! এটার জন্য দায়ী আমরাই। যারা সমাজ পরিচালনা করে তারাই। আমাদের সময় ৫০–৬০ বৎসর আগের কথা। ধনী, গরীব সবারই বিয়ের অনুষ্ঠান হতো উঠানে। স্কুলমাঠে, মসজিদে মন্দিরের সামনে। তখন আনন্দটাও দীর্ঘস্থায়ী হতো। পাড়াপড়শিরা, অন্যপাড়ার লোকজন অংশ গ্রহণ করতো। চদুল, পালকি ব্যবহৃত হতো। প্রকৃত একটা উৎসব। আর এখন গাড়ি করে আসে খেয়ে গাড়িতে চলে যায়। ঢোল, ব্যান্ডপার্টি ছিল, আসরে বাজি পোড়ানো হতো, মাইক বাজাতো, খাবার দাবার সব হতো। এখন গরীবের ঘোড়া রোগ হয়েছে। তাই বললাম যদি ভিক্ষা করে ক্লাবে বিয়ে দিতে হবে, অন্তত আমার কাছে ভিক্ষে চাইতে এসো না। আমি মনে করি ইচ্ছা করলে পারিবারিকভাবে ইহার সমাধান করা যায়। তাতে উভয়পক্ষ রক্ষা পায়। এমনও দেখেছি ক্লাবে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা হয়, ইহা ধনীদের মানায়। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের মানায় না। যৌতুক দিতে পারছে না, ক্লাব ভাড়া নাই বলে কত মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। পরিবারে অশান্তি লেগেই আছে। কত বিনীদ্র রজনী মা–বাপের কাটে। তাই এক কথায় বলতে চাই ইহার জন্য বিপ্লব দরকার। যৌতুক প্রথা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। সমাজে এক শ্রেণির পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার হচ্ছে সর্বস্বান্ত। এটার কারণে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছে কত নারীর সংসার। কত স্বপ্ন চুরমার হচ্ছে নিমিষে। অকালে নিভে যাচ্ছে জীবন প্রদীপ। সোজা কথায় এটা নিতান্তই সামাজিক ও পারিবারিক ব্যাপার। সমাজ চাইলে কঠোর হস্তে ইহা সুরাহা করা যায়। সরকারি আইন অনেক লম্বা প্রসিডিউর দরিদ্র পরিবারগুলি ইহা থেকে মুক্তি চায়। চায় জোরালো বিপ্লব। পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে গঞ্জে সভায়, ঘরোয়া বৈঠকে যৌতুকের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। যে বোঝে না তাকে বোঝাতে হবে। নতুবা শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। স্লোগান হোক বিয়ে হবে পারিবারিক উঠানে, মসজিদে, স্কুল–মাঠে, মন্দিরে, হলঘরের সামনে। গ্রামের ক্লাব, সমিতিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, মাতব্বরদের ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, ইউনিয়ন বোর্ডের জোরালো ভূমিকা থাকতে হবে। অচিরেই জোর করে যৌতুক নেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষার হার দিন দিন বাড়ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। এখনও কেন নিরীহ কন্যারা যৌতুকের বলি হবে। দেশে চারিদিকে বৈষম্যবিরোধী হাওয়া বইছে। আমরা চায় সমাজ বিপ্লবীরা এগিয়ে আসুক। তবে কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারগুলি রক্ষা পাবে।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপতাল, চট্টগ্রাম।