আগে পাহাড় কাটা হতো রাতে, এখন দিনেও কাটে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

আগে রাতে কাটা হতো, এখন দিনেও কাটে।’ পাহাড়খেকোদের ব্যাপারে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন স্থানীয়রা। তারা বলেছেন, অনেকদিন ধরে এখানে পাহাড় কেটে নানা ধরনের ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। গত কিছুদিন ধরে বেশ লম্বা একটি রাস্তা বানানো হচ্ছে। ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোড থেকে ভাটিয়ারীবড় দীঘির পাড় লিংক রোড পর্যন্ত আড়াআড়ি একটি রাস্তা তৈরি করার বৃহৎ এক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেছে তারা। ইতোমধ্যে আধা কিলোমিটারেরও বেশি পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। বাকি অংশের পাহাড়ও রাতে দিনে কাটাকাটি চলছে। পাহাড় কেটে তৈরি করা রাস্তার দুই পাশের সরকারিবেসরকারি জায়গা দখল করে বিক্রি করার মহোৎসব চলছে। পাহাড় কাটার এই কার্যক্রম আগে রাতে চললেও এখন দিনের বেলায়ও প্রকাশ্যে চলছে। সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

শহরে একের পর এক পাহাড় সাবাড় করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে পরিবেশ আন্দোলনে জড়িত বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, গত চার দশকে শহরের ১২০টি পাহাড় সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। যেগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোও ক্রমান্বয়ে শেষ করে দেয়ার তোড়জোড় চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় বায়েজিদের জালালাবাদসহ সন্নিহিত অঞ্চলে হরদম পাহাড় কাটা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র এবং সরজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোড নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের পর থেকে এই রাস্তার পাশের শত শত একর পাহাড়ে ভূমিদস্যুদের চোখ পড়ে। ইতোমধ্যে নামে বেনামে বহু প্রভাবশালী মানুষ এলাকার পাহাড় দখল করে নিয়েছেন। অনেকেই বস্তি তৈরি করে ঘর ভাড়া দিয়েও আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। এলাকার বহু পাহাড় ইতোমধ্যে সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি পাহাড়েই পড়েছে ভূমিদস্যুদের কোপ। যে কয়েকটি পাহাড় এখনো আস্ত আছে সেগুলোও ক্রমান্বয়ে সাবাড় করে দেয়ার অপতৎপরতা চলছে। এসব পাহাড় কেটে জায়গা বিক্রি এবং বস্তি নির্মাণের জন্য ভূমিদস্যুরা বেশ বড় ধরনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তারা ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোড থেকে উত্তর দিকে ভাটিয়ারিবড় দীঘির পাড় লিংক রোড পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করতে চাচ্ছে। এই রাস্তাটি তৈরি করা সম্ভব হলে পাহাড়ি দুর্গম এলাকাটি বেশ ভালো নেটওয়ার্কে চলে আসবে। তখন এলাকার পাহাড়গুলোর দাম অনেক বেড়ে যাবে। সংঘবদ্ধ চক্রটি সরকারিবেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড় কেটে কাঙ্খিত রাস্তাটি তৈরির কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পাহাড় কেটে প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। গত বেশ কিছুদিন ধরে মাঝেরঘোনার বাহারদইজ্যা থেকে বেতুয়াছড়া পর্যন্ত এলাকায় কয়েকটি পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। এই রাস্তাটিকে ফৌজদারহাটবায়েজিদ লিংক রোডের এশিয়ান উইমেন ইউনির্ভাসিটির উল্টো পাশে ছিন্নমূলের দিকে যাওয়া রাস্তাটির গোলাপের দোকান এলাকায় যুক্ত করা হবে। অন্যদিকে ভাটিয়ারীবড়দীঘির পাড় লিংক রোডের ইসলামপুর এলাকায় যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেনানিবাসের সীমানার পশ্চিম পাশ দিয়ে রাস্তাটি তৈরি করে পুরো এলাকাটিতে দখলদারিত্ব কায়েমের চেষ্টা করছে একটি মহল। অত্যন্ত সক্রিয় মহলটি শুরুতে রাতের বেলায় পাহাড় কাটলেও গত কিছুদিন ধরে প্রকাশ্যে শুরু করেছে।

ভূমিদস্যু চক্রটি সরকারি পাহাড় সাবাড়ের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়ও কাটছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে মোহাম্মদ সামশুল আলম নামের একজন গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমার মালিকানাধীন পাহাড় কেটে তারা রাস্তা বানাচ্ছে। বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও পারিনি। ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে জানিয়েছি। তিনি বিভিন্নজনকে ফোন করেছেন। কিন্তু পাহাড় কাটা থামেনি।

২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহেদ ইকবাল বাবু মোহাম্মদ সামশুল আলমের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি সরেজমিনে দেখেছি। পাহাড় কেটে রাস্তা করা হচ্ছে। বহু পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। তিনি পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ফোন করে পাহাড় কাটার কথা জানিয়েছেন বলে জানান। হাটহাজারীর এসি (ল্যান্ড) রায়হান সাহেবকে ফোন করে সহযোগিতার পাওয়ার কথা জানিয়েছেন শাহেদ ইকবাল বাবু। তিনি বলেন, আমার এলাকায় অনেক পাহাড় ছিল। ভূমিদস্যুরা তার বেশির ভাগ কেটে ফেলেছে। যেগুলো আছে সেগুলোও কেটে ফেলা হচ্ছে। আমি নানাভাবে চেষ্টা করেও পাহাড়গুলো রক্ষা করতে পারছি না। তিনি একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এলাকার পাহাড়গুলো রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান চার দশকে চট্টগ্রামের ১২০টি পাহাড় সাবাড় করে দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় সাবাড় করা হচ্ছে। আমরা নানাভাবে দাবি জানিয়েছি, আন্দোলন করেছি, প্রেস কনফারেন্স করেছি। কিন্তু পাহাড় কাটা থামাতে পারিনি। রাতে দিনে পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জালালাবাদ এলাকায় বহু পাহাড় ছিল। সবই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।

একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে আলীউর রহমান বলেন, স্বাধীনতার বহু পরেও চট্টগ্রামে ২০০ পাহাড় ছিল। গত চার দশকে যার ৬০ শতাংশের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া হয়েছে। পরিবেশ প্রকৃতি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থেই পাহাড় কাটা থামানো জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আল্লামা তাহের শাহ্‌ (মাজিআ)
পরবর্তী নিবন্ধগার্মেন্টস শ্রমিক বিদেশ পাঠানোর নামে অর্থ আত্মসাৎ, হোতা আটক