আগুনের শিখা জ্ঞানকে ধ্বংস করতে পারে না

অনুপ দাশগুপ্ত

| শুক্রবার , ২৮ জুন, ২০২৪ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি নব রূপে জাগরিত হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় নালান্দা। নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নবজাগরণ এই সত্যকে প্রমাণ করলো যে, বই আগুনের শিখায় জ্বলতে পারে, কিন্তু আগুনের শিখা জ্ঞানকে ধ্বংস করতে পারে না। এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গর্ব ছিল এখানকার পাঠাগার। নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’। এখানে ছিল তিনটি অতিকায় বহুতল বিশিষ্ট ভবন। ভবন গুলোর নামছিল ‘রত্নসাগর,’ রত্নোদধি’, ও’ রত্নরঞ্জক’। সব মিলিয়ে কত বই এখানে ছিল তা জানা না গেলেও লক্ষাধিক বই যে ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত ইতিহাসবিদেরা। বলা হয়, উপনিষদের কয়েকটি অংশের আসল পাণ্ডুলিপি ছিল এখানে। ছিল প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র ও গুহ্যসমাজের মতো ধর্মগ্রন্থও। আর সেই সব অমূল্য সম্পদ শেষ হয়ে গিয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখায়। শোনা যায়, তিন মাস ধরে দাউ দাউ করে জ্বলেছিল উন্মত্ত অগ্নি।

নালান্দা তিনটি সংস্কৃতি শব্দ নাআলমদা এর সংমিশ্রণ, যার অর্থ ‘জ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য প্রবাহ’। গত ১৯ জুন, নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ক্যাম্পাসের উদ্ভোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, নবনির্মিত ক্যাম্পাসটি অবস্থিত বিহারের রাজগীরে নালান্দার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের কাছাকাছি। নালান্দা ভারত তথা এই উপমহাদেশের একাডেমিক ঐতিহ্য এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতীক বলে দাবি করে নরেন্দ্র মোদি ঐ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নালান্দা হল, এই সত্যের ঘোষণা যে, বই আগুনের শিখায় জ্বলতে পারে, কিন্তু আগুনের শিখা জ্ঞানকে ধ্বংস করতে পারে না। নালান্দা হল একটি পরিচয়, সম্মান এবং গর্ব’।রাজগীরে একটি নতুন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ধারণার প্রস্তাব রেখেছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে আবদুল কালাম। ২০০৬ সালে, বিহার বিধান মণ্ডলের একটি যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময়, কালাম নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরুজ্জীবিত করার আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছিলেন, যেটি কারো কারো মতে ছিল বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের সংসদ নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০এর মাধ্যমে নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এই আইনটি দ্বিতীয় পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে (ইএএস) (ফিলিপাইন, ২০০৭) এবং (থাইল্যান্ড, ২০০৯), ‘একটি বুদ্ধিভিত্তিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক অধ্যয়ন সাধনা ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য আগত সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়নের ভিত্তি তৈরি করে’।

২০১৪ সালে ১৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি অস্থায়ী অবস্থান থেকে কাজ শুরু হয়, এবং ২০১৭ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যদিও ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, এই প্রতিষ্ঠানের আসল প্রেরণা ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বে আসে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও বৃত্তি কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বড় উদ্যম নেওয়া হয়েছিল। এটি ২১ শতকের বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্টতা। নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ যেখানে মিলেছিল সেই এলাকা জাতীয় হেরিটেইজের তকমা পেয়েছিল ২০১৬ সালে, জাতিসংঘ দ্বারা। নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘নালান্দা শুধু একটা নামই নয়। নালান্দা একটি পরিচয় ও শ্রদ্ধার জায়গা। নালান্দা শিক্ষার মন্ত্রোচ্চারণ করায়, মূল্যবোধ জাগ্রত করে’।

১৭০০ কোটি টাকায় নবনির্মিত রাজগীরের ক্যাম্পাসে ২ টি ব্লকে ৪০ টি বড়োসড়ো শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। যেখানে ১৯০০ জন পড়ুয়ার বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যাম্পাস হোস্টেলে ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও শিক্ষাকেন্দ্রের বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, আলোচনা সভার জন্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার, অডিটরিয়াম। রয়েছে স্পোর্টস ক্লাব, ফ্যাকাল্টি ক্লাব। এই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত ছাড়াও অন্যান্য ১৭টি দেশের অংশগ্রহণ রয়েছে; অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ভুটান, ব্রুনাই দারুসালাম, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মরিশাস, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, পর্তুগাল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম। এসব দেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থনে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এটি আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য ১৩৭ টি বৃত্তি প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে এশিয়ান ইন্ডিয়া ফান্ড, বিআইএমএসটিইসি স্কলারশিপ এবং এমইএ দ্বারা ভুটান স্কলারশিপ অর্থায়ন করা। এটি স্নাতকত্তোর এবং ডক্টোরাল গবেষণা কোর্স এবং স্বল্পমেয়াদী সার্টিফিকেট কোর্স অফার করে।

নালান্দার ধ্বংস ভারতীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের হৃদয়ে একটি গভীর এবং তীব্র আঘাত ছিল। যে শিক্ষা ও উন্নয়ন সভ্যতাগত মূল্যবোধের অগ্রভাগে, বর্তমান ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ল্যান্ডস্কেপ হয়ত অন্যরকম দেখাত। যদি নালান্দা তার যন্ত্রণাদায়কদের হাতে যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল তা থেকে রক্ষা পেত। নালান্দা (৪২৭, ১১৯৭) ছিল একটি বৌদ্ধ সন্যাসী বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাচীন মগদে শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। ৪২৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা কুমার গুপ্তের আমলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নির্মাণ করেন এই শিক্ষাকেন্দ্র। বৌদ্ধ ধর্মের গবেষেণা, ধর্ম চর্চাই ছিল প্রধান। পাশাপাশি পড়ানো হত হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞানের আরও বেশ কয়েকটি বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চলত রাজ আনুকূল্যে। মেধা এবং একমাত্র মেধাই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের চাবিকাঠি। রাজপরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও কোনও রকম পক্ষপাতিত্বের সুযোগ ছিল না পড়ার জন্য। কোনও বেতন দিতে হত না পড়ুয়াদের। আজ ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে। হাজার দশেক ছাত্র। দেড় হাজার শিক্ষক। চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, তুরস্ক, শ্রীলংকার মতো নামা দেশ থেকেও মেধাবী পড়ুয়ারা ভিড় জমাতেন সেখানে।

নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে হানাদারদের প্রকোপে বিভিন্ন সময়েই পড়তে হয়েছে। ৪৫৫ থেকে ৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৎকালীন হুন সম্রাট মিহিরকুল হামলা চালালে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। সেটা সমুদ্রগুপ্তের আমল। তিনি নতুন করে ঢেলে সাজান নালান্দাকে। সেই সময় আরও বাড়িয়ে দেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিধি। এরপর সপ্তম শতাব্দীতে এখানে হামলা চালান বাংলার হানাদার গৌরদাস রাজবংশ। এই আঘাতও সয়ে নিয়েছিল নালান্দা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটশো বছরের প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের কবলে পড়তেই হয় ১১৯৭ খ্রিষ্টাব্দে, যখন তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজির বাহিনী আছড়ে পড়ল অধুনা বিহারের এই অঞ্চলে।

রাতারাতি খাঁ খাঁ শ্মশানে পরিণত হয় জ্ঞান ও মেধার এক অনন্ত ভাণ্ডার। কিন্তু কেন? উত্তর ভারতে হামলা চালানোর সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন খিলজি। সেই সময় সেখানকার এক রাজা তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও শেষ পর্যন্ত শরীর আর ভালো হচ্ছিল না। বরং উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছিল অবস্থা। এই সময়েই তাঁকে কেউ কেউ উপদেশ দিল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ূর্বেদের প্রধান রাহুল শ্রীভদ্রের কাছে যেতে। কিন্তু খিলজির তাতে সায় ছিল না। ভারতের কোনও চিকিৎসক তাঁর স্ত্রী কিংবা প্রভুদের থেকে বেশি যোগ্য, এটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শরীর সারাতে তাঁকে দ্বারস্থ হতেই হয় রাহুলের কাছে। কিন্তু সেই সঙ্গে জেদি খিলজি এক অদ্ভুত শর্ত দিয়ে বসলেন। তাঁর শর্তটি ছিল তিনি কোনও ওষুধ খাবেন না। এহেন শর্তেও দমলেন না রাহুল। তিনি খিলজিকে কুরআনের কযেকটি পাতা পড়তে দিলেন। আর এতেই যেন ঘটে গেলো ম্যাজিক! সেরে উঠলেন খিলজি। আসলে কুরআনের ঐ কয়েকটি পৃষ্ঠাতে তিনি ওষুধ লাগিয়ে রেখেছিলেন। জিভে আঙ্গুল ঠেকিয়ে কুরআনের পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে অজান্তেই সেই ওষুধ সারিয়ে তুলেছিল খিলজিকে। ক্রমেই তিনি চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এতে তাঁর রাহুলের উপরে দারুণ খুশি হওয়ার কথা। পুরস্কার দেওয়ার কথা কিন্তু ভারতের চিকিৎসকরা তুরস্কের চিকিৎসকদের থেকে যে বেশি যোগ্য সেটি তিনি সহ্য করতে পারলেন না। ফলে তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়ল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে। তারপর কী হলো তা ভাবলে আজও শিউরে উঠতে হয়। এত বছরের লব্ধ জ্ঞান চর্চা, মেধা সব জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। সেই সঙ্গে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে জীবন্ত অবস্থাতেই পুড়িয়ে মারা হল। কারও কারও মাথা কেটে ফেলা হয়। যাঁরা বেঁচে যান তাঁরাও পালিয়ে যান সেখান থেকে। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যায় নালান্দা। সেই আগুন যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল এবং ঝলমলে কাচের কণাগুলি স্থির হয়ে গেল; সংস্কৃতি, নীতিশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের সমস্ত জ্ঞান যা দীর্ঘ আট শতাব্দী ধরে সঞ্চিত ছিল, ধোঁয়ায় পরিণত হয়েছিল বায়ুমণ্ডলে ছডিয়ে পড়ে এবং তারপরে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। যা অবশিষ্ট ছিল তা ছিল অনিশ্চিত ভাবে ঝোলানো ইটের কাঠামো এবং সমস্ত জায়গা জুড়ে কালি। খিলজির আগুনের ক্রোধে ভারতের আধ্যাত্মিক আত্না এক গভীর অন্ধকারে পরিণত হয়েছিল।

খিলজির রাগের পিছনে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মিথটিই সত্য, নাকি ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গিয়েছে অন্য কোনও কারণ তা আজ বলা কঠিন। তবে যে কারণই থাক, হানাদারের অক্ষম ক্রোধের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা কেবল ভারতের নয়। বলা যায় সমগ্র এশিয়ার শিক্ষাজগতের কাছেই এই ক্ষতি ছিল অভাবনীয় ও অপূরণীয়। আজও ইতিহাসপ্রেমী মানুষের সংবেদনশীল মন চোখের সামনে দেখতে পায় এক মহান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীর কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ঘৃণার আগুনে। তিনি যে বই ও নথিপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং যে সন্ন্যাসীদের শিরচ্ছেদ করেছিলেন তারা ভারতের মহান ঐতিহ্য ‘গুরুশিষ্য প্রথার’ রক্ষক ছিলেন। ধ্বংস করেছিলেন ৮ শতাব্দী ধরে অমূল্য জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার এক গৌরবময় ইতিহাস।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধউম্মাহর দুর্দিনে ওলামায়ে কেরামের করণীয়