আগামী থিয়েটার কেমন হবে

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

১৩ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৩ সাল। চট্টগ্রামে শুরু হলো গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। চট্টগ্রামের সংস্কৃতির ভুবনে নতুন মাত্রা এনে দিল। গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় যুক্ত হলেন এক ঝাঁক তরুণ। সেই থেকে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা চলে আসছে। অনেক সমৃদ্ধ প্রযোজনা আছে। বরেণ্য অভিনয় শিল্পী আমরা পেয়েছি। নির্দেশক পেয়েছি। নাট্যমঞ্চ পেয়েছি। চট্টগ্রামের নাট্যদল, নাট্যপ্রযোজনা এবং নাট্যকর্মী ঢাকা ও দেশের বাইরে পরিচিত পেল। গত ৫০ বছরের চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার যে অর্জন, পরবর্তী সময়ে এই থিয়েটার চর্চার গতিপথ কি হবেএই নিয়ে আজ ভাবতেই হচ্ছে। কারণ, বিগত সময়ের অর্জন, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করছে চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ।

বিগত সময়ে চট্টগ্রামের নাট্যমঞ্চ আমাদের সৃজনশীল অনেক নাটক উপহার দিয়েছে। অভিনয় শিল্পী পেয়েছি। নাট্যদর্শক পেয়েছি। ঢাকার থেকে আলাদা ভাবার অবকাশ হয়নি। একটা সময় চট্টগ্রাম পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে নাট্য প্রযোজনায়। মেধা ও সৃজনশীলতায় চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারকর্মীরা নন্দিত হয়েছেন।

কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে, আগামী ৫০ বছরের কথা ভাবলে, কিভাবে এগিয়ে যাবে এই নাট্যচর্চা তা এখন নতুন করে ভাবতে হবে। প্রথমেই যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো নাট্যকার। বিগত ৫০ বছরে চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য মৌলিক নাট্যকারের ভীষণ অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। আমরা অনেকটা সময় অনুবাদ, বাইরের অন্য নাট্যকারের নাটক দেখেছি। চট্টগ্রামের নাট্যকার একেবারেই হাতেগোনা। সেই বাস্তবতার নিরিখে নাট্যনির্দেশক শিশির দত্ত যখন বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের যে উপাদানগুলো আছে, এগুলো আসলে চট্টগ্রামের নাটকে যথার্থ ব্যবহার করতে পারিনি। এগুলো ব্যবহার করতে পারলে আমার মনে হয় দর্শকদের মধ্যে আরেক ধরনের বৈচিত্র্য তৈরি হবে। তাছাড়া চট্টগ্রামে এখন যতগুলো নাট্যদল আছে, সেই পরিমাণ আমরা নাট্যকার তৈরি করতে পারিনি।’ তাঁর কথায় চট্টগ্রামের গত ৫০ বছরের নাট্যকার তৈরির বিষয়ে একটা গভীর শূন্যতা দেখতে পাই। এটাই বাস্তবতা। এখনো আমরা দেখি, নতুন নাটক মঞ্চায়নের জন্য বাইরের নাট্যকারের স্ক্রিপ্ট খুঁজি। এই বিষয়টিও আগামীর নাট্যচর্চার ভাবনায় চলে আসে।

দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার যুক্ত আছেন আহমেদ ইকবাল হায়দার। তিনি বললেন, ‘নাট্য চর্চায় এখন আর আবেগ দিয়ে ভাবলে হবে না। প্রফেশনালি ভাববার সময় এসেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে এখন আমাদের সেই জায়গায় যেতে হবে। শূন্য জায়গাটা কিংবা আকাংখার জায়গাটা পূর্ণ করতে হবে। আজকের নবীন নাট্যকর্মীদের মাঝে প্রফেশনাল দায়িত্ব ও চেতনা সৃষ্টি করাতে হবে। নিজের জীবনকে গুছিয়ে সৃজনশীলতাকে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। এটা তো মানতে হবে, সত্তর দশকে আমাদের বেড়ে ওঠা, আর এখনকার প্রজন্মের বেড়ে ওঠার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তাই আগামীর নাট্যচর্চার ভাবনায় এইসব বিষয়কে প্রাধান্য দিতেই হবে।’ আহমেদ ইকবাল হায়দারের কথায় একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আগামীর নাট্যকর্মীর গড়ে তোলার উপায়। এটিও তাঁর দীর্ঘদিনের নাট্যচর্চার অভিজ্ঞতা থেকে প্রসূত।

বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী শুভ্রা বিশ্বাস। তিনিও তারুণ্যেও সময়কাল থেকে যুক্ত চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারচর্চায়। তিনি বললেন, ‘বিগত ৫০ বছরে আমাদের প্রাপ্তি তো অনেক। আমরা সৎ ও কর্মঠ নাট্যকর্মী পেয়েছি। চট্টগ্রামের নাটক পরিচিতি পেয়েছে। নাটক তো আর শুধু বিনোদন নয়। জাগরণেরও। রাজনৈতিক সংকটের সময় চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা পথনাটক, মঞ্চ নাটক করে জনগণের সাথে থেকেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। এখন দেখছি, আগের সমৃদ্ধ প্রযোজনাগুলো আবার নতুন করে মঞ্চায়ন করছে বিভিন্ন দল। এই বিষয়টি ইতিবাচক। কারণ, বর্তমান প্রজন্ম তো আগের সমৃদ্ধ প্রযোজনাগুলো দেখেনি। তা দেখে তাদের উপলব্ধির জায়গাটা সমৃদ্ধ হবে। আরেকটি বিষয়কে আমি গুরুত্ব দিয়ে বলি, আমাদের নাটকগুলো যদি অনুবাদ করা যায়, তাহলে বিদেশেও চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের নাট্যজগত ও নাট্যচর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। বিদেশি নাট্যকর্মীরাও আমাদের নাটক সম্পর্কে অবহিত হবে। আগ্রহী হবে। সবজায়গায় জোয়ারভাটা আছে। নাটকের ক্ষেত্রেও আছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ভাটায় যেন ভেসে না যাই। আমাদের বর্তমান তারুণ্যকে উদ্বুদ্ধ করে চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অনেক সংকট আছে। কিন্তু এই সংকট উত্তরণের উপায় নিয়ে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে আগামীর গ্রুপ থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।’

গত ৫০ বছরের আমরা নাট্যদর্শক তৈরিতে কতটা সফল হয়েছি, এটাও এখন ভাবতে হবে। ত্রিশ বছর আগেও যে দর্শক ছিল, তা এখন নেই। এটা বাস্তবতা। দর্শক ছড়িয়েছিটিয়ে গেছে। আগের নবীন দর্শক প্রবীন হয়েছেন। এখন প্রশ্ন জাগে, গত দশ বছরে চট্টগ্রামে নবীন নাট্যদর্শক কি পরিমাণ বেড়েছে? আদৌ কি বেড়েছে? মধ্যবিত্ত সমাজের নাট্যদর্শক, যাঁদের আনুকূল্য একসময়ে চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারগুলো পেয়েছিল, তা কি অব্যাহত আছে আজ? বাস্তবতা বলে, বর্তমান থিয়েটার দলগুলো তা এখন আর পাচ্ছে না। এর কারণ কি? এটাও আমাদের এখন ভাবতে হবে। বিশ বা ত্রিশ বছর আগেও গ্রুপ থিয়েটার যেভাবে তারুণ্যকে নাড়া দিয়েছিল, তা কি আজ করতে পারছে? এক্ষেত্রে মনে হয়, গ্রুপ থিয়েটারচর্চা সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের ভয় হয় ঐতিহ্যবাহী ‘যাত্রা’ ক্রমশঃ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রায় হারিয়ে গেছে। থিয়েটারে যদি এমন হয়, তখন আমাদের সামনে আর তেমন কোন পথ খোলা থাকবে না। থিয়েটার কর্মীদেরকেই নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। তাই আমাদের এখন ভাবতে হবে নতুন করে, নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্ব যুক্ত হবে? নাকি সৌখিন নাট্যচর্চা চলতে থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পঞ্চাশ বছর স্বপ্ন, সংগ্রাম ও সৃজনের পথচলা