জুলাই–আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নবতর মাত্রা সংযোজন করেছে এবং আক্ষরিক অর্থেই তা দীর্ঘদিনের চলমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কোটা বিরোধী আন্দোলন হোক বা উদ্ভুত অন্য যে কোনো কারণে হোক গত ১৫ বছর ধরে অনুসৃত ডেমোক্র্যাসির নামে ক্লেপ্টোক্র্যাসির বা কতক দুর্বৃত্ত ও লুটেরা স্তাবকে পরিবেষ্টিত চূড়ান্তভাবে গণবিচ্ছিন্ন এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর পতন ছিল একটি অনিবার্য পরম্পরা। ১৯৮০’র দশক থেকে এরশাদ কর্তৃক অনুসৃত ও এরশাদ পরবর্তী দুই বৃহৎ দলের এবং তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিন্ন নীতি কৌশল তথা মুক্ত বাজার লুটেরা রাজনৈতিক অর্থনীতি দেশে জন্ম দিয়েছে কিছু লুটেরা অতি ধনাঢ্য পরিবারের যারা সব সরকারের আমলের বেনিফিসারী এবং শেখ হাসিনার আমলে সীমাহীন লুটপাট করে মূলত দেশের আর্থ–রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে। দুর্নীতিবাজ আমলা, লুটেরা দুর্বৃত্ত ও অসৎ রাজনীতিবিদদের এই ত্রিভুজ বিগত ১৫ বছর ধরে দেশকে নিষ্ঠুরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ক্রোনি ক্যাপিটেলিজমের এই নিকৃষ্টতম শাসন ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হল নির্বাচনী প্রহসন, জবাবদিহিতাবিহীন আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও জবরদস্তি, শাসকদের চরম অসহিষ্ণু ফ্যাসিবাদি আচরণ, পরমত ও পরধর্ম অসহিষ্ণুতা তথা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, মুক্তচিন্তা চর্চার প্রতিবন্ধকতা, আর্থিক ও আদর্শিক রাহাজানির দমবন্ধ অন্ধকার এক জগত। প্রকৃত অর্থে বৃহৎ দলগুলো আজ এতই দেউলিয়া হয়ে পড়েছে যে তারা বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও সহ্য ও ধারণ করতে পারছে না। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনের নামে ভোটারবিহীন, বিরোধীদল বিহীন নির্বাচনী প্রহসন এর প্রমাণ। এদের অনুসৃত এই ক্লেপ্টোক্র্যাটিক শাসনের ধারা হল চিরায়ত পুঁজিবাদের নিকৃষ্টতম রূপ। কাকতালীয় ব্যাপার হল এই পতিত সরকারের কথিত বিরোধী বলে জনগণের কাছে আপাত প্রতিভাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এই লুটেরা শাসন ব্যবস্থা বা ‘নিউ লিবারেল অর্থনীতি’ দেশে দেশে চাপিয়ে দিয়ে এই স্বৈরশাসনের পথ উন্মুক্ত করে দেয় গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্ত করে। অর্থনীতিই যেহেতু রাষ্ট্র ক্ষমতার নির্ণায়ক শক্তি রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ে সংযুক্ত হলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে সুস্পষ্ট অবস্থান পরিষ্কার করা বাঞ্চনীয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক খাতের মত গণসম্পৃক্ত বিষয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা খর্ব করার প্রচলিত ভাবনা এই আন্দোলনের বহুল কথিত ‘বৈষম্য ও সংস্কারের’ বিপ্রতীপ বিষয়।
বিগত সরকারগুলোর অনুসৃত রাষ্ট্রীয় দর্শন তথা ‘নিউ লিবারেল অর্থনীতির’ বৈশ্বিক ও এদেশে তার আজকের পরিণতির প্রেক্ষিতে এর ইতিবৃত্তের সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক। মধ্যযুগের স্বেচ্ছাচারী সামন্তবাদী অভিজাত ব্যবস্থাকে উঠতি বণিক শ্রেণি উচ্ছেদ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে। রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে দীর্ঘ রক্তাক্ত সংঘাতের ফলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের মাধ্যমে সূচিত ইহজাগতিক জীবনবোধ বা রেনেসাঁ বলতে গেলে ইউরোপের মধ্যযুগের সমাপ্তি ও আধুনিকতার সূচনা করে। একটি বমধষরঃধৎরধহ বা মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ভাবাদর্শিক আন্দোলনের সূচনা হয়। একই সময়ে বিজ্ঞানের নবতর আবিষ্কার উৎপাদিকা শক্তির প্রভূত বিকাশ ঘটায়। এই শিল্প বিপ্লব পুঁজির মালিকদের মুনাফাবৃদ্ধি করে কিন্তু কাঁচামাল ও উৎপাদিত বিপুল পণ্যের বাজারের অভাব দেখা দেয়। অন্যদিকে এই ধনবাদী অর্থনীতির অবাধ বিকাশের জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ে সামন্তবাদী শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত শাসন ব্যবস্থা। এরই লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সাম্য স্বাধীনতার উচ্চকিত বাণীতে সংঘটিত হয় ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে উপরোল্লিখিত শিল্প বিপ্লব, রেনেসাঁ ও বিজ্ঞানের প্রভাবে এক সেকুলার উদার নৈতিক সামাজিক ভাবধারা এই সব বিপ্লবের প্রাণশক্তিতে রূপলাভ করে এবং ইউরোপে ‘গণতন্ত্র’ নামে একটি শাসন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে। আব্রাহাম লিংকন এই গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করলেন ‘ডেমোক্র্যাসি অব দি পিপল, বাই দি পিপল, ফর দি পিপল’ নামে। কিন্তু এই বুর্জোয়া গণতন্ত্র অভিজাত সামন্তবাদের চেয়ে বেশি গণসংপৃক্ত হলেও কখনো ‘ফর দি পিপল’ ছিল না। ১৮৬১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে দাস প্রথা রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু ছিল ও ১৯২০ সাল পর্যন্ত নারীর ভোটাধিকার ছিল না। ইতিহাসের এই সময় পর্যন্ত পুঁজিবাদের প্রগতিশীল বিশ্বজনীন চরিত্র বজায় ছিল কিন্তু শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও উৎপাদিত বিপুল পণ্যের বাজার খুঁজতে গিয়ে অষ্টাদশ শতকে বৃটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা ও এশিয়া হয়ে অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত দখল করে নেয়, হত্যা করে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ আর ধ্বংস করে অসংখ্য আদিবাসী সভ্যতা। হত্যা, ধ্বংস ও বিভীষিকার মাধ্যমে পুঁজিবাদ স্থাপন করল বিশ্ব উপনিবেশিক ব্যবস্থা। এভাবে সেই তথাকথিত ‘সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা’। কিন্ত পুঁজিবাদের অন্তর্গত সংকট তথা অসম বিকাশের ফলে ইতিহাসের অনিবার্য গতিধারায় সংঘটিত হয় দুটি বিশ্ব যুদ্ধ। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ভস্মাধারের মধ্য থেকে উত্থিত সোভিয়েত বিপ্লব ও বিশ্ব সমাজতন্ত্রের নবোদ্ভূত শক্তির চাপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভেঙে পড়ল ঔপনিবেশিক দুনিয়া। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তি ‘তৃতীয় দুনিয়া’ খ্যাত সেই সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে রেখে গেল ইতিহাসের পরিকীর্ণ বিশাল ভগ্নস্তুপ। ধর্মে–বর্ণে, মানুষে মানুষে বিভক্তি সৃষ্টি করে তাদের উচ্ছিষ্ট ভোগী স্থানীয় কিছু এজেন্টদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিল। তাদের আজ্ঞাধীন সেসব দেশীয় এজেন্টরা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাক্তন বিদেশী প্রভুদের নির্দেশ ও উপদেশে সাবেক প্রভুদের শাসন শোষণের ধারা অব্যাহত রাখল। কোথাও গণতন্ত্রের ছদ্মবেশী আবরণে, কোথাও সামরিক শাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে যা রাজনীতিতে ও সাহিত্যে নয়া ঔপনিবেশিক শাসন বা ‘পোস্ট কলোনিয়াল ডিসকোর্স’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্রের যাঁতাকলে ও পাঞ্জাবী বৃহৎ পুঁজির জাতিগত ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে নিস্পিষ্ট হয়ে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, নয় মাসের এক সশস্ত্র যুদ্ধ, বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন গণহত্যা, লক্ষ লক্ষ নারীর লাঞ্চনা আর বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের বিনিময়ে বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন দেশ হিসাবে আবির্ভুত হয় বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। ফলে স্বাধীন দেশটি বেছে নেয় পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিপরীত পথ– জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কর্মসূচি। পুঁজিবাদী অবাধ শোষণ, সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সহ রাষ্ট্র সাংবিধানিক ভাবে বেছে নেয় গণতন্ত্র, ইহজাগতিকতা, ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তা ও সমাজতন্ত্রের পথ। এটা কোন দলীয় ম্যানুফেষ্টো ছিল না। এটা ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধের লক্ষ শহীদদের রক্ত ও জীবনের দাবী। কিন্তু সেই বিপ্লবী চেতনাকে শাসকদল আওয়ামী লীগ ধারণ করতে পারেনি। দুর্নীতি, দলীয় সংকীর্ণতা ও প্রায় ডায়নেস্টিক শাসনের প্রভাবে সামষ্টিক ত্যাগ ও সংগ্রাম, মানুষের প্রত্যাশা পূরণে তা ব্যর্থ হল। সেই ব্যর্থতা ও ’৭১ থেকে চলমান মার্কিন চক্রান্তে সংঘটিত হল ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন হল সেনাবাহিনী। সেই পাকিস্তানি সামরিক শাসনের ধারায় দেশ ফিরে গেল। দুই সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদের নেতৃত্বে ও সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাবে অর্থনীতিতে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের ধারা চালু হল। ইতোমধ্যে ১৯৭০ এর দশকে বিশ্ব পুঁজিবাদ নজিরবিহীন এক সংকটে পড়ার পর কিছুটা উদারবাদী কেইনসীয় অর্থনীতির পরিবর্তে ১৯৭৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ফ্রিডম্যানের সুপারিশে নিউ লিবারেল অর্থনীতি নামে বিশ্বব্যাপি এক নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি চালু করে পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্থবিরতা বা ‘ঝঃধমভষধঃরড়হ’ কাটানোর জন্যে যার মূল কর্মসূচি ছিল–কাঠামোগত সংস্কারের নামে নির্বিচারে সব সরকারি কলকারখানা, ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা ব্যাক্তিগত খাতে ছেড়ে দেয়া, অবাধ শুল্ক রেয়াত দেয়া, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, সরকারি পরিষেবা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সরকারি ভর্তুকি একেবারে বন্ধ করে দেয়া সর্বোপরি সব কিছুর প্রাইভেটাইজেশন। ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’ খ্যাত এই রাজনৈতিক অর্থনীতি আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যাংক সাহায্যের শর্ত হিসাবে চাপিয়ে দেয় সহজে বিরাজমান রাজনৈতিক শুন্যতা ও সামরিক শাসনের সুযোগে। এরশাদ আমলে আর্থিক লুটপাটের এই ধারা দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি ব্যাংক–বীমা, কল–কারখানা অতি কম মূল্যে, সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে মূল্য প্রদান সাপেক্ষে ছেড়ে দেয়া হয়। সামরিক আমলাতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে সর্বত্র। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি পুঁজির দ্রুত বিস্তৃতি ঘটে। এ দেশে কম সময়ে ব্যক্তি পুঁজির অস্বাভাবিক বিকাশের রেকর্ড তৈরি হয়। এ ব্যক্তি পুঁজির সাথে দ্রুত ব্যাংক পুঁজির সম্মিলনে গড়ে উঠে শক্তিশালী অলিগার্কি বা লুটেরা চক্র। এই সময়েই আজকের সালমান রহমানদের উত্থান। শিক্ষার প্রাইভেটাইজেশন যেমন শিক্ষার মানকে, শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ককে বাণিজ্যায়নের মাধ্যমে কলুষিত করে, তেমনি স্বাস্থ্য খাত পরিণত হয় লাভজনক ব্যবসায়। রাজনীতির চূড়ান্ত বাণিজ্যায়ন ঘটে ও চালু হয় নীতিহীন বাজার রাজনীতি। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কাকরাইল, মতিঝিলের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা রাজনীতির কর্ণধার হয়ে উঠে। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের নাগালের বাইরে চলে যায়। রাজনীতি ও অর্থনীতির এই দুর্বৃত্তায়ন গত ৪০ বছরে ক্রমে অতি শক্তিশালী হয়ে আজ রাষ্ট্রকে দুর্বৃত্তায়িত করে তুলেছে। এরি ধারায় বিএনপির আমলেও লুটপাট ও নির্বাচনী প্রহসনে একই খেলা চলেছে। বস্তুত ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনীতিতে একটি ভয়ের সংস্কৃতি ও এক স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে, কিন্তু গত ১৫ বছরে তা এক অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।
আজকে নজিরবিহীন ও নির্বিচারে ব্যাংক ও শেয়ার বাজার লুট তো একটি আর্থ রাজনৈতিক পরম্পরার সাথে সর্ম্পকিত। নির্বাচনী প্রহসন তথা ভোটার বিহীন নির্লজ্জ নির্বাচনী কর্মকাণ্ড তো এই দুর্বৃত্তায়নের অনিবার্য ফসল। এরই প্রতিক্রিয়ায় সমাজে– রাজনীতিতে আজকের সংকট তথা অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি। এরশাদ ক্ষমতার প্রয়োজনে ইচ্ছামত ধর্মীয় কার্ড খেলেছে। কথিত অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের দাবীদার শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই ২০১০ সাল থেকে একের পর এক ঘটেছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। ক্ষমতার সমীকরণে কোনো একটি ঘটনার ও বিচার হয়নি, সৃষ্টি হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। গড়ে উঠছে গভীর সাম্প্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্ব।
অর্থনীতির একজন বিদগ্ধ শিক্ষক হিসাবে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আজকের সংকটের মূল কারণ ‘নিউ লিবারেল অর্থনীতির’ নামে দুর্নীতিগ্রস্ত, লুটেরা, কালো টাকা সৃষ্টির ও দুর্বৃত্তয়ানের উৎস সম্পর্কে নিশ্চয়ই সচেতন। এই প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করার সুস্পষ্ট বক্তব্য না আসলে, কথিত ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’ এর নামে ‘রেগান–থেচারের’ লুটেরা আর্থ–রাজনৈতিক দর্শন থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি না আসলে, মৌলিক ও ইতিবাচক কোনো সংস্কার সঠিকভাবে কার্যকর ও টেকসই হবে না। ব্যবস্থার বদল ছাড়া ব্যক্তির বদল তো কোনো পরিবর্তন কখনো আনেনি। এজন্যই মুক্তিযুদ্ধ বা ‘ভিশন ৭১’ এর পথেই হাঁটতে হবে। যার রাজনৈতিক অর্থনীতি হল ব্যক্তি পুঁজির অবাধ বিকাশ রোধ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ, প্রকৃত গণতন্ত্র, ক্রমে বৈষম্যহীন সমাজ বা সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা। প্রত্যেকটি শাসকদল গত ৫৩ বছর ধরে এর ঠিক বিপরীতে হেঁটেছে। আজও মানুষের মৌলিক অধিকার নানা কৌশলে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। ১৯৭১ এর নৃশংস গণহত্যাকে লঘু করার অপচেষ্টা চলছে। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় মেধার সম্মিলনে, মানবিক আন্তরিকতায় আমাদের এগুতেই হবে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির দুঃসহ শাসনের অবসানে, অনিশ্চিত আগামী থেকে মানুষকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এই বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাসের নিরালম্ব এই কুজ্ঝটিকায় প্রতিক্রিয়ার কুৎসিত নৃত্য আর ভাঙ্গনের উৎসব–মত্ততার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতার শেষ স্তবক উদ্বৃত করে বলতে চাই–
এসো যুগান্তের কবি/ আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মি পাতে/ দাঁড়াও ঐ মানহারা মানবীর দ্বারে/ বলো ক্ষমা করো-/ হিংস্র প্রলাপের মধ্যে/ সেই হোক সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক; কলমিস্ট ও প্রাবন্ধিক।