সত্যজিৎ রায়ের ছবি নিয়ে আমাদের আলোচনা এখনও ফুরোয়নি। দিন যত যায়, আমাদের দেখার ধরন যত বদলায়, তাঁর একেকটি ছবি নতুন তাৎপর্যসহ ধরা দেয়। দেখার ধরন বলতে এখানে কেবল নতুন–নতুন তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করে ছবি দেখার কথা বলছি না, বরং এই ‘দেখা’ হল জগৎ ও পারিপার্শ্বিকের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। যে দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে, এবং বদলের ফলস্বরূপ, আজ, পরিবেশ–প্রকৃতির সঙ্গে প্রজাতি হিসেবে মানুষের যাবতীয় সম্বন্ধ, বিনিময়, পারস্পরিকতা, সবকিছু এমন এক আশ্চর্য সময়ের মধ্যে আমাদের এনে ফেলেছে। এই আশ্চর্য সময়কে চিহ্নিত করে নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়: ভয়াবহ তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা, জলবায়ু ও ঋতুচক্র চিন্তাজনকভাবে ঘেঁটে যাওয়া, সুনামি, বিধ্বংসী দাবানল, মাটির প্রকৃতিতে উদ্বেগজনক পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, বেলাগাম দূষণ ইত্যাদি ইত্যাদি। নৃতাত্ত্বিকরা কেউ কেউ এই সময়টিকে বলছেন Anthropocene, অর্থাৎ মানুষ–কেন্দ্রিক ভূ–তাত্ত্বিক সময়কাল, যখন পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের দীর্ঘকালীন উপস্থিতি এবং যেমন–খুশি হস্তক্ষেপ জীবজগতের জন্য (এবং এমনকি মানুষের নিজের জন্যেও) ভয়াবহ অভিঘাত নিয়ে হাজির হয়েছে। আবার বামপন্থীদের মতে, এই পরিস্থিতির জন্য সব শ্রেণির মানুষকে সমান অভিযুক্ত করা চলে না, বরং একে Capitalocene বলা ভাল, কেননা পরিবেশের এই সার্বিক অধোগমনের জন্য পুঁজিবাদই দায়ী। কারণ? কারণ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কথা চিন্তা না করে পুঁজিপতিরাই লাগামছাড়া উৎপাদন এবং সেসব ব্যবহারে মানুষকে প্রতিনিয়ত আরও সামিল করার কাজগুলো করে চলে। মানুষেরও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল ভাল থাকতে চাওয়া, ফলে গরম যত বাড়ে, এয়ারকন্ডিশন, রেফ্রিজারেটর বিক্রিও তত বৃদ্ধি পায়, এবং ততই গ্রিন হাউজ গ্যাস বাড়ে; যার জন্য গরম আবার বাড়ে। এ–এক জটিল আবর্ত! তবে যে–নামেই ডাকা হোক, তার প্রতিপত্তি একই। মানুষের সৃষ্টি করা ভাল–থাকার–উপায়গুলিই শেষ পর্যন্ত এই গ্রহ; গ্রহস্থিত সকল প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য আত্মঘাতী।
এমন একটি অবস্থায় এই পৃথিবীতে বাস করছি, আমাদের বাসস্থানের এই বিপদের কথা চলচ্চিত্রেও এসেছে। বস্তুত চলচ্চিত্রে এনভায়রনমেন্টাল বা ইকোলজিক্যাল আলাপ আজ আর নতুন কিছু নয়। এই ধরনের সিনেমাকে বিদ্যায়তন নাম দিয়েছে ইকো সিনেমা। এই সিনেমাগুলি আবার মোটা দাগে দুই প্রকার: প্রথমত সরাসরি ইস্যুভিত্তিক; দ্বিতীয়ত যেসব ছবি সরাসরি কোনও ইকোলজিক্যাল বয়ান রাখে না বটে, তবে সেভাবে পাঠ করলে এর থেকে কোনও বয়ান পাওয়া যেতেও পারে। আমার পাঠে, সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ এই দ্বিতীয় প্রকারের একটি ইকোসিনেমা। এযাবৎ ‘আগন্তুক’–এর যে ক’টি পাঠ আমরা পাই, তা হল সভ্যতা-(অ)সভ্যতার দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোকের বৈষয়িকতা, আত্মকেন্দ্রিকতার সমালোচনা ইত্যাদি। আশিস নন্দী লিখলেন শেষ ছবিতে সত্যজিতের আত্ম–অতিক্রমণ এবং আত্ম–খণ্ডনের কথা। একথা ঠিকই যে, যে নেহরুবাদী প্রগতির তিনি একসময় সেলুলয়েড–রূপকার ছিলেন, নেহরু–উত্তর সময়ে সেই আধুনিকতার ওই পরিণতি (সীমাহীন বেকারত্ব, দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয়) দেখে তিনি সমালোচনা করে গেলেন, একরকম অসহায়ভাবে, ব্যথিতচিত্তে। ‘আগন্তুক’–এর মূল চরিত্রই বস্তুতপক্ষে এই স্ব–বিরোধ যার মূর্ত রূপ মনমোহন মিত্র। একথা জেনেও, মনমোহন মিত্রকে অন্যভাবে পড়তে পারি।
স্বচ্ছল জীবনের সুযোগ উপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে, দীর্ঘ ৩৫ বছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরে যখন কিছুদিনের জন্য নিজ দেশে অবস্থান করেন, তখন আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতা নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা, অভিব্যক্তি, এবং অভিমত সবকিছু একবার লক্ষ করুন, তিনি মানুষের যে সার্বিক অধঃপতনের কথা পৃথ্বীশের (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে তর্কের সময় উল্লেখ করছেন, খুব সন্তর্পণে সেইসব তর্কে, আধুনিক নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত প্রগতিশীল মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে যে দূরত্ব ও বৈরিভাব, যা কিনা মানুষেরই ‘অর্জন’, তারই আভাস আজ পাওয়া যায় না? যখন তিনি দেশী ও বিদেশী নানান জনজাতির কথা বলছেন, তখন আদতে কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে একটি সহজাত অন্তরঙ্গতার কথা বোঝান, যে অন্তরঙ্গতা আধুনিক টেকনোলজিক্যাল মানুষ ভুলে গিয়েছে। আধুনিক মানুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে কেবলই প্রয়োজনে, বিধ্বংসীভাবে, নির্বিচারী প্রভুর মতো করে। কিন্তু তথাকথিত একজন আদিম জনজাতীয় ওঝা ৫০০ রকম ঔষধি গাছগাছড়ার ব্যবহারও জানেন; সেই বনের সংরক্ষণও জানেন। মনমোহন শিশুদের নিউ ইয়র্ক শহরের ছবি দেখান না, তিনি দেখান পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো ইনকা সভ্যতার ছবি, মাচু পিচুর ছবি, যখন যন্ত্রপাতি আর পরিবেশ–বিধ্বংসী টেকনোলজি আসার অনেক আগেই মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল ওইসব তৈরি করা। আমরা জগতের সঙ্গে, মাটি–জল–বাতাসের সঙ্গে সেই সদ্ভাব, সৌজন্য রাখতে পারিনি। এখন পাঁচ কিমি রাস্তা নির্মাণের কাজে জলবাতাসের অমোচনীয় ক্ষতি আমরা করি। মনমোহন যেন একজন ক্লান্ত ও দুঃখিত অপু। হেডমাস্টারমশাই যার হাতে ‘মনের প্রসারের’ জন্য বই তুলে দিয়েছিলেন; যে অপু বিদেশ দেখে বই পড়ে, মনের চোখে, মনমোহন যেন বাস্তবে সে কাজটি করলেন। মানুষের অসীম প্রতিপত্তির যুগে তিনি সেই প্রতিপত্তিকে সন্দেহ করলেন, তিনি বললেন কূপমণ্ডূক না–হবার কথা, বাইরে বেরোবার কথা। মানুষ যখন ক্রমশ এসি–বসানো খোপের ভিতরে–ভিতরে অভ্যস্ত হচ্ছে, যখন ‘বাহির’ আমাদের জীবন থেকে আজ হারাবার পথে, কেননা এখন সময় বাহিরকে সঙ্কুচিত করে হাতের মুঠোয় এনে ফেলার। কাজেই কৃষিকে ধ্বংস করার সবরকম ‘অত্যাধুনিক’ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ছাদবাগান আর প্লাস্টিকের পাতাবাহারশোভিত এই যুগে ‘আগন্তুক’ দেখে আমার বারবার ‘অপরাজিত’–র অপুর ক্লাসরুমের ওই আবৃত্তিটা মনে পড়ে: ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল, কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয় রে দূর্বা কোমল’।
জ্যোতির্ময় বিশ্বাস : কবি–চলচ্চিত্র গবেষক; শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ