সপ্তাহের দিন সমূহকে ভাষা ভেদে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলা ভায়ায় শনিবার, রবিবার, সোমবার, প্রভৃতি আরবিতে ইউমুস সাবতে, ইউমুল আহাদ, ও ইউমুল ইছনাইন, আর র্ফাসি ভাষায় শোম্বাহ, এক শোম্বাহ, দু’শোম্বাহ, ছে’শোম্বাহ, চাহার শোম্বাহ, পঞ্জে শোম্বাহ বা জুমারাত, জুমাহ, এভাবেই সাত দিনের নাম প্রচলন রয়েছে আখেরী অর্থ শেষ, চাহার শোম্বাহ অর্থ বুধবার অর্থাৎ সফর মাসের শেষ বুধবার কে আখেরী চাহার শোম্বাহ বলা হয়।
পটভূমি : ১১ হিজরীর শুরুতে সফর মাসের শেষের দিকে হুজুর (দঃ) গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন, শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি উঠে দাঁড়াতেও পারছিলেন না। ফলে মসজিদে নববীতে নামাজের ইমামতি পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রঃ) নামজের ইমামতি করছিলেন। সাহাবীগণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়েন এবং হুজুর (দঃ) এর ইন্তিকালের ভয় সবার মাঝে সঞ্চারিত হয়ে যায়। সফর মাসের ৩০ তারিখে বুধবার হুজুর (দঃ) সুস্থ হয়ে উঠেন। মা আয়েশা (রাঃ) কে ডেকে বললেন, আমার জ্বর কমে গেছে আমাকে গোসল করিয়ে দেন। অতঃপর মসজিদে নববীতে সাহাবীদের নামাজের ইমামতি করেন। রাসূলুল্লাহ (দঃ) সুস্থ হয়ে গেছেন এই খবর মদিনার অলি–গলিতে ছড়িয়ে পড়লে মদিনাবাসী খুশি হয়ে দলে দলে রাসূলুল্লাহ (দঃ) কে আল্লাহর রাস্তায় দান, সদকা করেন, নফল নামাজ আদায় করেন, দাস–দাসী মুক্ত করেন, উট, দোম্বাহ কোরবানী করেন। বিশেষত হযরত আবু বকর (রঃ) ৫ হাজার দিরহাম, হযরত ওমর ৭ হাজার, হযরত ওসমান (রঃ) ১০ হাজার আর হযরত আলী (রঃ) ৩ হাজার, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ ১০০ উট আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। এই দিনটি তাদের কাছে অন্যতম খুশির দিন ছিল। রোগ মু্ক্ত হয়ে হুজুর (দঃ) গোসল করেছেন বিধায় পরবর্তীতে সাহাবী, তাবেয়ী, আল্লাহর ওলীগণ সফর মাসের শেষ বুধবার অর্থাৎ আখেরী চাহার শোম্বাহ দিনটিতে গোসল করেন, দান–খয়রাত, নফল নামাজ, রোজা প্রভৃতি ইবাদত পালন করে এসেছেন, আমরা সাধারণ মানুষ ও রাসূল (দঃ) এর রোগ মুক্তির দিনে, তাঁর সুন্নাতের অনুসরণে দোয়া–দরূদ পাঠ করি, রোগ মুক্তির নিয়্যতে গোসল করি বরকতময় পানি পান করি। এতিম–মিসকিনকে খাদ্য দানসহ প্রভৃতি ইবাদত করে থাকি।
সফর মাসে প্রচলিত কুসংস্কার ও ইসলামের শিক্ষা
ইসলামের প্রাক্কালে তথা জাহেলি যুগে সফর মাসকে দুঃখ দুর্দশার মাস মনে করা হতো। বর্তমান সমাজে অনেকে এ মাসে বিয়ে–শাদি, আচার–অনুষ্ঠান, প্রভৃতি ভালো কাজ করা থেকে দূরে থাকে। অমঙ্গল ও অশুভ মনে করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন মা আছাবাকুম মিন মুছিবাতিন ফাবিমা কাছাবাত আইদিকুম ওয়া ইয়াফু আন কাছির। অর্থাৎ তোমাদের উপর যে সকল বিপদ –আপদ বালা–মুছিবত আসে তা তোমাদের কর্মের ফল। আর আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অনেক গুনাহ (পাপ কাজ) ক্ষমা করে দেন। (সুরাহ: আশশুরা ,আয়াত :৩০)
বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা ধন, সম্পদ, সুখ–সমৃদ্ধি দান করে পরীক্ষা করেন, বান্দা এ নিয়ামত পেয়ে অহংকার করেন, না কি বিনয়ী হয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আর ধন–সম্পদ কেড়ে নিয়ে, বালা–মুছিবত দিয়ে, রোগ ব্যাধি প্রদানের মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষা করা হয় যে,বান্দা সবর ধৈর্যের মাধ্যমে মালিক আল্লাহর আনুগত্য আব্যহত রাখে না–কি হতাশা গ্রস্থ হয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি নাফরমানী ও বে–দ্বীন হয়ে যায় সুতরাং প্রকৃত মুসলমান সুখে–দুঃখে সর্বদা আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবিচল আস্থা রাখে, দুঃখে তাঁর রহমত ও সাহায্য কামনা করে আর সুখে তাঁরই প্রদত্ত রহমত–বরকতের শোকর আদায় করে থাকেন, সফর মাস সম্পর্কে রাসূলে আকরাম (দঃ) ইরশাদ করেন সফর মাসে রোগের কোনো সংক্রমণ নেই। নেই কোনো অকল্যাণ (আল মুসনাদ, আল জামেউল কবির) অগণিত হাদিস শরিফে সফর মাসকে বিশেষ মর্যদাবান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (শরহে বুখারী: ইমাম কিরমানী, আল নিহায়া: ইবনুল আসির) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বলেন, রাসূলে করিম (দঃ) ইরশাদ করেন কোন মাসকে অকল্যাণ মনে করা হারাম। কেননা সকল মাস দিন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিয়ামত স্বরূপ, কারো কোন অকল্যাণ হলে, দুর্দশা এলে সে যেন আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল রাখে এবং এস্তেগফার করে, আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুলের কারণে আল্লাহ বান্দার উপর থেকে মুছিবত দূর করেন।
সফর মাসের ফজিলত
জাহেলীযুগে আরবরা সফর মাসকে দুঃখের মাস মনে করতো, সফর মাসের চাঁদ পর্যন্ত দেখতো না সফর মাস যাতে দ্রুত শেষ হয়ে যায় তার জন্য তাকিয়ে যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দিত। রাসূল (দঃ) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাসের সুসংবাদ দিবে, আমি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করব, সফর মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ ৩টি রোজা রাখা, ফরজ নামজের পাশাপাশি সুন্নাত ও নফল নামাজ বেশি বেশি আদায় করা, দান–খায়রাত করা প্রভৃত আমল করার ব্যাপারে রাসূল (দঃ) বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছেন ।
আখেরী চাহার শোম্বাহ এর আমল:
সফর মাসের শেষ বুধবার গোসল করা সুন্নাত, এ দিন হুজুর (দঃ) আরোগ্য লাভ করে গোসল করেছেন, মসজিদে নববীতে উপস্থিত হয়ে যোহরের নামাজের ইমামতি করেছেন, মা ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (র) কে সাথে নিয়ে খাবার খেয়েছেন। এই দিন মদিনা শরীফে উৎসবের আমেজ বিরাজমান ছিল, বুজুর্গানে দ্বীনগণ এই দিনে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পবিত্র কুরআনের ৭ টি সালামের আয়াত পড়ে বুকে ফুঁক দিতেন এবং সুরা ফাতিরের ৪১ নং আয়াতটি নকশা সহ কলাপাতা বা কাগজে লিখে পানিতে ভিজিয়ে তা দিয়ে গোসল করে আল্লাহ তায়ালা অশেষ দয়া ও মেহেরবানী অর্জনের জন্য আমলটি করতেন, মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দার আমল ও আচরণের উপর ভিত্তি করে তার রিজিক ও বলা মুছিবত মওকুফ বা বৃদ্ধি করেন, নানা নিয়ামত ও বলা মুছিবতের মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষা করেন, বান্দার ইমান যত বেশি মজবুত হবে, আল্লাহ তায়ালার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখবে আল্লাহ তায়ালা সেই বান্দার প্রতি তত বেশি সন্তুষ্ট ও দয়াবান হবেন। আল্লাহ তায়ালার মাকবুল বান্দাদের আমলগুলোর মধ্যে এটি একটি ভালো আমল। পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলোর সাহারা নিয়ে জাহেরী–বাতেনী নানা রোগ মুক্তির জন্য এই দিনে বিশেষ গোসল ও দোয়া যুক্ত পানি পান করা হয়। যাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন প্রকার সুযোগ নেই। এ জাতীয় আমল পবিত্র কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে প্রিয় হাবিব (দঃ) উচিলায় ভালো আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন, বেহুরমতে সায়্যেদিল মুরসালিন।
লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।