আখেরাতের প্রস্তুতি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

(পর্ব)

মানুষের অনেক স্বপ্ন থাকেসেই স্বপ্নের আকাশ ছোঁয়া ভাবনা নিয়ে যেতে চায় ভিনদেশে, গড়তে চায় নতুন ইতিহাস। পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় মহাকাশেশূন্য বলয়ের সীমারেখায় ভেসে ভেসে ওড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ যেন স্বপ্নের পোস্টমর্টেমএক সময় থেমে যায় জীবনের বাস্তবতা। গহীন আঁধারে চলে যেতে হয় স্বপ্ন বোনা সেই মানুষদের। এই জীবন এক ক্ষণিকের জগৎ। কোন এক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়া জগৎএরপরই শুরু অন্তিম নিবাসযার শুরু আছে, শেষ নেই। মানুষ জীবনে অনেক বড় হতে চায়, বড় শিক্ষাবিদ, নোবেলজয়ী, বিশ্ব স্কলার, স্বনামধন্য চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, আইনজীবি, বড় আমলা, দেশের মূখ্য কর্মকর্তাদেশ বিদেশে যশ পেতে চায়, খ্যাতি পেতে চায়। নিজেকে বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করার জন্য কতই না প্রাণান্তকর চেষ্টা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কত কূটকৌশল, অপকৌশল, জালিয়াতির আশ্রয় নেয়যার কোন হিসাব নেই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসমহাশক্তিধর আল্লাহতায়ালার সামনে এসবের কিছুই মূল্য নেই। দুনিয়ায় কে, কি ছিল, কোন পদবী ধারণ করেছিল, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, সাংসদ, সচিব এসবের কানাকড়িও মূল্য নেই সেই কেয়ামতের মাঠে অথচ হতদরিদ্র নেক আমলদার সেই দুস্থ ভিখারির মর্যাদা তাদের চেয়ে বড়ই দামি হবে আল্লাহতায়ালার কাছে, ‘যারা ঈমান এনেছে, হিযরত করেছে এবং আল্লাহতায়ালার পথে তাদের জানমাল দিয়ে জেহাদ করেছে, তাদের মর্যাদা আল্লাহতায়ালার কাছে সবার চাইতে বড় এবং এধরনের লোকেরাই সফলকাম হবে’সূরা আততওবা২০। যে ধন সম্পদের ভেতর মানুষ ডুবে আছেএর চেয়ে কোটি কোটি গুণ ধন সম্পদের অধিকারী হওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই। আর আল্লাহর কাছে সেই কোটি গুণ ধন সম্পদ লাভ করার যোগ্যতার মাপকাঠিতে আমরা অনেক পিছিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশিত এবং রাসূল (সাঃ) এর প্রদর্শিত জীবন না গড়ার কারণে। জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি কানাকড়ি, প্রতিটি মেহনতের জবাব পরোয়ারদিগারের কাছেই দিতে হবে। আর যে সমস্ত সম্পদশালী পৃথিবীর বুকে বিচরণ করছেসম্পদের অহমিকায় পায়ের তলায় মাটি থাকে না, অহংবোধ যার সমস্ত শরীরেতার জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব, ‘যে (কাড়ি কাড়ি) অর্থ জমা করে এবং তা গুণে রাখে, সে মনে করে তার এই অর্থ তাকে দুনিয়ায় স্থায়ী করে রাখবে; না, কখনো নয়, অল্প দিনের মধ্যেই সে নির্ঘাত চূর্ণ বিচূর্ণকারী আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে’সূরা আল হুমাযাহ,৩ ও ৪। কেয়ামতের মাঠে ৫টি প্রশ্নের অন্যতম প্রশ্নই হল এটি। অর্জিত অর্থ কোন পথে আয় করেছ আর কোন পথে ব্যয় করেছ? এই কঠিন প্রশ্নটির জবাব কি সেদিন সবাই দিতে পারবে? অধিকাংশ জবাব না সূচক আসবে আর এটাই সত্য। আমরা কি এটি ভেবে দেখেছি? আমরা কোন পথে আয় করছি? আমাদের আয় হালাল আছে কিনা, নাকি হারাম পথে আমাদের আয়ের বসবাস। আর এই হারামপথে উপার্জনের কারণে আমাদের দোয়া আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছায় না। নেক আমল অর্জন করতে গেলে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত সহ্য করতে হবে। বিপদে কঠোর ধৈর্য্যের পাঠশালা তৈরী করা চাই। আর ক্ষমাই যেন হয় মানবজীবনের একমাত্র অনুষঙ্গ আর সেটাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে, ‘সুন্দর কথা বলা এবং ক্ষমা করে দেওয়া সেই দানের চাইতে অনেক ভালো, যে দানের পরিমাণে কষ্টই আসে; আল্লাহতায়ালা কারোই মুখাপেক্ষি নন, তিনি পরম ধৈর্য্যশীল’সূরা আল বাকারা২৬৩। কঠিন পরিস্থিতিতে ক্রোধ সংবরণ করাও একজন মুমিনের জন্য মহৎ গুণ হওয়া চাই। সামর্থ্যহীন অবস্থায়ও আল্লাহর রাস্তায় দান করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে বারবার, ‘(আল্লাহ ভীরু হচ্ছে তারা) যারা সচ্ছল হোক কিংবা অস্বচ্ছলসর্বাবস্থায় (আল্লাহরপথে) নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে, যারা নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে এবং যারা মানুষদের ক্ষমা করে দেয়; আল্লাহতায়ালা উত্তম মানুষদের ভালবাসেন’ সূরা আলইমরান১৩৪। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত বেলাল (রাঃ) কে আল্লাহর পথে দান করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন অথচ সেই বেলাল (রাঃ) ছিলেন একজন কপর্দক শূন্য সাহাবীযার পরিধানের বস্ত্র ছিল অত্যন্ত সীমিত। অথচ অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে আমরা অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় দান করার জন্য আগ্রহী হই না। আর এটাই নেগেটিভ পয়েন্ট হবে আগামী কেয়ামতের ময়দানে। আখেরাতের প্রস্তুতির জন্য এখন থেকে যদি সঠিক পথে তথা আল্লাহতায়ালার পথে ধন সম্পদ ব্যয় করার জন্য উদ্যোগী না হই তাহলে আমাদের নেক আমলের পাল্লা ভারী হওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকলো না, ‘আমি তাদের যেই রিযিক দান করেছি তা থেকে তারা (আমারই পথে খরচ করে)’- সূরা আশ শূরা৩৮। নেক আমল করার তামান্না থাকতে হবে সারাদিন, সারাক্ষণ। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, যদি আমার নিকট উহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ মজুদ থাকত, তবে গ্রহণ করার মত কোন লোক পাওয়া গেলে এবং আদায়যোগ্য ঋণের জন্য সংরক্ষিত রাখা ছাড়া তার নিকট থেকে একটি মাত্র দিনার অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় আমার উপর ৩টি রাত অতিক্রান্ত হোক। এটা আমি পছন্দ করতাম না’ (সহীহ বুখারী৬৭২৪)। নিজেদের পরিবারপরিজনকে সাথে নিয়ে একত্রে জান্নাতে থাকার আশাপোষণ করা জরুরি কারণ দুনিয়ায় সবাই আমরা সহাবস্থান করছি। কিন্তু আখেরাতে এই সহাবস্থান যে টিকে থাকবে এটির কোন নিশ্চয়তা নেই কারণ পৃথিবীতে উপার্জিত নেক আমল দ্বারাই প্রমাণিত হবে কাল কেয়ামতের মাঠের ফয়সালা। সেজন্য হায়াত থাকা অবস্থায় হায়াতের অপব্যবহার যেন না হয় সেজন্যে নিজেকে নিজের উপর এবং নিজ পরিবারের উপর কঠোর হওয়া চাই। আল্লাহতায়ালার সেই ঘোষণা যেন সবার পরিবারের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকে, ‘যারা (আল্লাহর উপর) ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানরাও এই ঈমানের উপর অনুবর্তন করেছে, আমি (জান্নাতে) তাদের সন্তানসন্তুতিদের তাদের (নিজ নিজ পিতামাতার) সাথে মিলিয়ে দিব, আর এই জন্যে আমি তাদের (পিতামাতার) পাওনার কিছুই হ্রাস করব না, প্রত্যেক ব্যক্তিই যা অর্জন করেছে তার হাতে বন্দি’সূরা আত তুর২১। নিজের পরিবারকে জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে বাঁচার জন্য জিন্দেগীর হায়াত থাকা অবস্থায় ফন্দি ফিকির করতে হবেনা হলে আখেরাতের শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ আর সেটি সূরা আত্‌ তাহরিমের ৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করছেন এভাবেই, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবার পরিজনদের (জাহান্নামের সেই কঠিন) আগুন থেকে বাঁচাও, তার জ্বালানী হবে মানুষ আর পাথর, (সেই) জাহান্নামে (প্রহরা যাদের) উপর (অর্পিত), সেই সব ফেরেশতা হচ্ছে নির্মম ও কঠোর, তারা আল্লাহতায়ালার কোন আদেশই অমান্য করবে না, তারা তাই করবে যা তাদের করার জন্য আদেশ করা হবে’। কেয়ামতের মাঠে প্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হল নামাজ আর আমার রাসূল (সাঃ) ওফাতের সময় তাঁর উম্মতের জন্য নামাজকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেছেন অতএব জাহান্নামে যাওয়ার জন্য এই নামাজকে উপেক্ষা করা একটি অন্যতম কারণ বলে আল্লাহর কোরআনে বিধৃত হয়েছে। ‘(হে জাহান্নামের অধিবাসীরা) তোমাদের আজ কিসে এই ্‌আযাবে উপনীত করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজীদের দলে সামিল ছিলাম না’সূরা আবাসা৪২, ৪৩। অতএব নামাজকে প্রাধান্য দেওয়া চাই, গুরুত্ব দেওয়া চাই। এই দুনিয়া এতই সংকীর্ণ যে তা আল্লাহতায়ালা তাঁর কিতাবে এভাবেই বর্ণনা করেছেন, ‘যেদিন এরা কেয়ামত দেখতে পাবে, সেদিন (এদের মনে হবে) তারা (দুনিয়ায়) এক বিকেল অথবা এক সকাল পরিমাণ সময়ের চাইতে বেশি সময় অতিবাহিত করেনি’সূরা আল নাযেয়াত৪৬।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজলো তোমার আলোর বেণু
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসের বরকর্মী আহমদ মমতাজ