পর্ব–২ :
আখেরাতের অন্তিম ঠিকানায় পৌঁছানোর আগেই আমাদের শিরকমুক্ত ঈমান, বেদআতমুক্ত ইবাদত নিয়ে অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি আছে কি? জবাবে অধিকাংশই না বোধক উত্তর আসবেই–এটা নিশ্চিত। দুনিয়ার জীবনটাকে আমরা এতই আপন করে নিয়েছি আখেরাত নিয়ে ভাববার কোন সময় আমাদের নেই ‘নারী জাতির প্রতি ভালবাসা, সন্তান–সন্ততি, কাঁড়িকাঁড়ি সোনা–রূপা, পছন্দসই ঘোড়া, গৃহপালিত জন্তু ও জমিনের ফসলকে মানব সন্তানের জন্যে লোভনীয় করে রাখা হয়েছে। (আসলেই ) এসব হচ্ছে পার্থিব জীবনের কিছু ভোগের সামগ্রী, উৎকৃষ্ট আশ্রয় তো একমাত্র আল্লাহতায়ালার কাছেই রয়েছে’– সূরা– আলে ইমরান–১৪। অর্থের পেছনে লাগামহীন ঘোড়ার মতন আমরা দৌঁড়াচ্ছি, এ লাগাম টেনে ধরার জন্য যেন কেউ নেই। জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজাতে এবং গোছাতে যেন আমরা মরিয়া হয়ে উঠছি। বসতঘরটাকে দামী টাইল্সে সাজানোর জন্যে কত যে আয়োজন তা বলে শেষ করা যাবে না। বিদেশী টাইল্স দিয়ে বসতঘরের দেওয়ালগুলোতে সেঁটে দেওয়ার কি যে প্রয়াস তা বলাই বাহুল্য। আর এই অর্থ কামানোর জন্যে আমরা বেছে নিচ্ছি অবৈধ পথ, দূর্নীতির পথ। আমরা কি একটু ভেবে দেখেছি, এর জন্য আমাকে কাল কেয়ামতের মাঠে মুখোমুখি হতে হবে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার সামনে? কেয়ামতের মাঠে ৫টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া কোন মাখলুকাতকে এক কদমও অতিক্রম করার সুযোগ দেবেন না আমার আল্লাহতায়ালা। তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রশ্ন হল: দুনিয়ার জীবনে অর্থ সম্পদ কোন পথে আয় করেছো এবং কোন পথে ব্যয় করেছো? আমরা কি সত্যি সত্যি এই দু’টো প্রশ্নের জবাব দিতে পারব সঠিকভাবে? অধিকাংশ মাখলুকাত এই প্রশ্ন দু’টির জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করবে সেদিন। তাহলে কেন এত ছোটাছুটি? কেন দুনিয়ার জন্য এত মরণ লড়াই? দুনিয়ার নেতৃত্ব পাওয়ার আশায়, বড়–সড় নেতা হিসাবে নিজেকে জাহির করার আশায় কত অন্যায়–অবিচার আমরা করছি–তার কোন ইয়ত্তা নেই। নিজেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্যে, যেমন: ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সাংসদ ইত্যাদির জন্যে বিরোধীপক্ষকে গুম, খুন করতেও আমাদের হাত, পা কাঁপে না অথচ এই জঘন্য অন্যায়ের কড়ায়–গন্ডায় হিসাব দিতে হবে কাল কেয়ামতের মাঠে মহাবিচারকের সামনে। দুনিয়ার মোহ আমাদের খুব বেশি টানছে। অথচ আল্লাহর কোরআন ঘোষণা করছে, ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবনটা খেলাধুলা, তামাশা, ঝাঁকঝমক, পরস্পর অহংকার প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, ধন–সম্পদ ও সন্তান–সন্ততি বাড়নো ছাড়া আর কিছুই নয়’ (এটা) যেন (আকাশ থেকে বর্ষিত এক পশলা) বৃষ্টি, যার (উৎপাদিত) ফসলের সমাহার কৃষকের মনকে খুশিতে ভরে দেয়, অতপর (একদিন) তা শুকিয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে তুমি দেখতে পাও তা হলুদ রং ধারণ করতে শুরু করেছে, তারপর তা (অর্থহীন) খড়কুটায় পরিণত হয়ে যায়, (এ তো হচ্ছে তাদের দুনিয়ার জীবন) আর পরকালের জীবনে (তাদের জন্য থাকবে) কঠোর আযাব এবং (ঈমানদারদের জন্য থাকবে) আল্লাহর পক্ষ থেকে (তাঁর) ক্ষমা ও সন্তুষ্টি, দুনিয়ার এই জীবন কতিপয় ধোকা, প্রতারণার সামগ্রী বৈ আর কিছুই নয়’–সূরা– হাদীদ–২০। এরপরও আমরা ছুটছি আর ছুটছি এই নশ্বর দুনিয়ার পেছনে, যে দুনিয়ার কোন মূল্য নেই আল্লাহর কাছে। এই দুনিয়াটা হচ্ছে মূলত আখেরাতের মাল সামানা জোগাড় করার মাধ্যম। যে মাল সামানা কাজে লাগবে স্থায়ী জীবন পরকালে কিন্তু আমরা সেই জীবনটাকেই পরকালের চেয়ে অতি প্রিয় করে নিয়েছি। ‘এ লোকেরা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন খরিদ করে নিয়েছে, তাদের উপর থেকে আযাব কিঞ্চিৎ পরিমাণও হালকা করা হবে না, না সেদিন তাদের সাহায্য করা হবে’–সূরা বাকারা–৮৬। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন – ‘বুদ্ধিমান ব্যক্তি সেই–যে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন’ (সুনানে তিরমিজী)। পরকালীন যাত্রার সকল মুসাফিরের উচিৎ মৃত্যুর আগেই কবরের সওয়ালের জবাব কি হবে? সেই প্রশ্নের উত্তর শিখে নেওয়া, কেয়ামত ময়দানের হিসাব নিকাশের সময় নিজের নেক আমালের পাল্লাকে ভারী করা, সর্বোপরি যে সকল কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। পরকালীন যাত্রীদের পাথেয় সম্পর্কে মুহাক্কিক উলামায়ে ক্বেরাম বলেন, ‘পরকালীন পাথেয় হল–তাওহীদ ও শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান, বিশুদ্ধ নেক আমল, সর্বাবস্থায় তাকওয়া, সদকায়ে জারিয়া, সুন্নতের পাবন্দি’– এই পাথেয় জোগাড় করার জন্যে দুনিয়ার জীবনকে দলিত–মথিত করে, দুনিয়ার সুন্দর ও আকর্ষণকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করে–নচেৎ পরকালীন সংকট হবে অধিকতর ঘনীভূত। আমরা যেন টাকার মায়া ছাড়তে পারি না। টাকার মোহ পাগলপারা করে ফেলেছে আমাদের, ‘অধিক (সম্পদ) লাভের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা তোমাদের গাফেল করে রেখেছে, এমনি করেই তোমরা কবরের কাছে গিয়ে হাজির হবে’–সুরা আত তাকাসুর–১,২। আখেরাতের জীবনে মুক্তির প্রধান পাথেয় হল তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা। নিজেকে শিরকমুক্ত রাখা। আল্লাহর কোরান বলছে, ‘তোমাদের উপাস্য হচ্ছে এক আল্লাহ, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই। তিনি পরমকরুণাময়, অতি দয়ালু’– সূরা বাকারা ১২২। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘(অপরদিকে) যারা আখেরাত (ও তার সাফল্য) কামনা করে এবং তা পাওয়ার জন্যে আল্লাহর উপর ঈমান রেখে চেষ্টা সাধনা করে, তারাই হচ্ছে এমন লোক যাদের প্রচেষ্টা (আল্লাহর দরবারে) স্বীকৃত হয়’–সূরা বনী ইসরাইল– ১৯। তিনি আরও বলেন, ‘সময়ের কসম! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে–তারা ছাড়া, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং নেক কাজ করে’ সূরা আসর–১–৩। এই মৃত্যু যে অবধারিত সত্য সেটি আমরা আল্লাহর কোরান থেকে জানি, ‘ তুমি বলো, অবশ্যই সে মৃত্যু যার কাছ থেকে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো, (একদিন) তোমাদের তাঁর সামনাসামনি হতেই হবে, তারপর তোমাদের সেই মহান সত্তা আল্লাহার দরবারে হাজির করা হবে, যিনি মানুষের দেখা ও অদেখা যাবতীয় সব কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, অতঃপর তিনি সেদিন তোমাদের সবাইকে বলে দিবেন তোমরা দুনিয়ার জীবনে কে কি করছিলে’– সূরা আল জুমুয়াহ– ০৮। যারা আল্লাহর নির্দেশিত পথে নিজের সময় ব্যয় করবে এবং রাসূল (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করবে তারাই সেই কঠিন দিনে সফলকাম হবে–এতে কোন সন্দেহ নেই। বান্দার উপর নির্ধারিত ইবাদতকে সঠিকভাবে পালন করা, ইসলামের আহকাম–আরকানগুলো সঠিকভাবে মেনে চলা এবং শুধু নামাজ পড়া নয়, এই নামাজকে প্রতিষ্ঠা করা জীবনের একমাত্র অনুসঙ্গ হিসাবে নেয় এবং যারাই এই মিশনে চলতে গিয়ে নিজের জীবনকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেয়, তারাই হবে সেদিনের মহাপুররস্কারপ্রাপ্তদের একজন। তাদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে, ‘অবশ্যই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করেছে, যাকাত আদায় করেছে, তাদের জন্যে তাদের মালিকের কাছে যথার্থ প্রতিদান রয়েছে, তাদের উপর কোন ভয় থাকবে না, তারা চিন্তিতও হবে না’– সূরা আল বাকারা–২৭৭। এ জীবন চলার পথে অনেক ঘাত–প্রতিঘাত আসবে। অবশ্যই সেটা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে কঠিন মরুদ্যান পেরিয়ে মঞ্জিলে মকসুদের দিকে। এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, এ পথ কন্টকাকীর্ণ। সেসব লোকদের আল্লাহতায়ালা খুব বেশি ভালবাসেন যারা নিজের রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে তাঁর কালামকে উড্ডীন রেখেছেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের তোমরা মৃত বল না; বরং তারাই হচ্ছে জীবিত, কিন্তু তোমরা কোন চৈতন্যই রাখ না’– সূরা আল বাকারা– ১৫৪।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল