আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু : ত্যাগী রাজনৈতিক ও সফল ব্যবসায়ী

মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন | সোমবার , ২ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ


বীর মুক্তিযোদ্ধা বরেণ্য শিল্পপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন ব্যক্তি নন,একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বললেও কম বলা হবে, বলতে হবে- একটি বটবৃক্ষ। বেসরকারি ব্যাংকিং জগতের সফল পুরুষ ও প্রদর্শক ছিলেন তিনি।
জয় করেছিলেন সাধারণ মানুষের মন। ভালবাসা অর্জন করেছিলেন রাজনৈতিক দল- মত ব্যক্তিদের। শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন আবাল বৃদ্ধ-বনিতাসহ ব্যবসায়ী-শিল্পপতি- ব্যাংকারদের। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় অবস্থান দৃঢ় করেছেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের।
১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি আইনজীবী ছিলেন। তার মাতার নাম খোরশেদা বেগম। ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ওই বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে পড়ালেখা করেন। সেখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। ১৯৬৫ সালে বড় ভাইয়ের সাথে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম আলহাজ্জ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নুর নাহার জামান এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
স্বাধীনতার পূর্বে তিনি বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, পানাম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল কিনে নেন। তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি দু’দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন বাবু। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটা জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিও) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি বাহাত্তর সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। শুধু রাজনীতিই নয়, তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুননির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র এবং ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সমাজ হিতৈষী, দানবীর ও জনদরদি ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায় বহু মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকরণীয় জীবন আদর্শ। আর ব্যক্তি আখতারুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। নির্লোভ, তার মাঝে কখনই কোন অহংকারবোধ আমার চোখে পড়েনি। ব্যক্তি আখতারুজ্জামান রাজনীতির মাঠে আওয়ামীলীগ করলেও অন্য সব দলের শীর্ষ নেতাদেরও সঙ্গে ছিল তার অত্যন্ত হৃদ্যতা এবং সখ্যতা। শুধু তাই নয়- ব্যবসায়ী সমাজের কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ব্যবসায়ী। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের কাছে তিনি ছিলেন পথ প্রদর্শকের মতো।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এমন কি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনার সাথেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেন। পরবর্তীতে দল পুনর্গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন- যা দেশের আওয়ামীলীগের রাজনীতির ইতিহাসে চির অমর থাকবে। সংসদ সদস্য হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এলাকার জনগণের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় জননেতা। রাজনীতি করতেন মাটি আর মানুষের সঙ্গে। সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবে নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি পরিবারের সুখ- দুঃখে তিনি ২৪ ঘন্টা গ্রামের বাড়ি ও শহরের সার্সন রোডের বাসার দরজা খোলা রাখতেন। অ্যাপায়ন ব্যতিত তার বাসা থেকে কেউ কোনদিন আসতে পারে নি। এলাকার এমন কোন বয়সের লোকজন নেই-তার নাম জানতেন না। অনুজদের সবাইকে দেখা হলে নাম ধরে ডাকতেন-মুরব্বীদের কুশলাদি খোঁজ নিতেন। ফলে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তার ছিল চমৎকার সেতুবন্ধন। সারাজীবন কাজ করেছেন জনকল্যাণে। দেশের কল্যাণে। আর ব্যবসা করেছেন দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে। অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। ফলে তার প্রতিষ্ঠা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে আরো দীর্ঘদিন। যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে প্রতিনিয়ত।
তিনি ব্যক্তি জীবনে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যার জনক। বড় ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি বর্তমানে আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্বে। সফল মন্ত্রী হিসেবে দু’মেয়াদে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। ই-নাম জারির অসামান্য ভূমিকা রাখায় মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে “ইউনাইটেড নেশন পাবলিক এ্যাওয়ার্ড-২০২০” এ ভূষিত হওয়ায় মন্ত্রী হিসেবে মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সুযোগ্য পুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বাংলাদেশ তথা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন। পুরো ভূমি মন্ত্রণালয়ই এখন সরকারের অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থার কাছে মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মেজ ছেলে আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমিও একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর এ মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দানবীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে কিডনি জটিলতায় জীবনের সাথে পরাজয় বরণ করে ইন্তেকাল করেন। মহান আল্লাহ্‌ তাকে বেহেস্ত নসিব করুক। আমিন॥
লেখক : এআইজি (প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ-১), বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রাক্তন ছাত্র,
হাইলধর বশিরুজ্জামান স্মৃতি শিক্ষা কেন্দ্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবাই বন্ধু হতে পারে না
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি