আক্রান্ত প্রতি চারজনের একজন শিশু

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৪:০১ পূর্বাহ্ণ

মধ্য আগস্টের পর থেকে বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন কমছেই না চট্টগ্রামে। বরঞ্চ এ রোগে আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হার যেন দিনদিন বাড়ছে। তবে এ রোগে সবচেয়ে বেশি ধরাশায়ী হচ্ছে শিশুরাই। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ২৯ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর ১১ জনই শিশু। হিসেবে এটি মোট মৃত্যুর প্রায় ৪০ শতাংশ। আর ৯ জন নারী ও ৯ জন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে, মোট আক্রান্তদের মাঝেও শিশুর সংখ্যা কম নয়। চলতি বছর ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার (৩ হাজার ৯৪০ জন) ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৯৫৬ জন। এটি মোট আক্রান্তের ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রতি চারজনের একজন শিশু। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ডেঙ্গু সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩১৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে চমেক হাসপাতালে। এর মাঝে শিশু রোগীর সংখ্যা ২০০। আর হাসপাতালে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। এর মাঝে ৫ জনই শিশু। আগের ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া ২৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ৬ জন শিশু বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গু শনাক্তে দেরি এবং রোগীকে হাসপাতালে আনতে বিলম্বের কারণেই আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

আর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলেও ঠিকমতো বলতে না পারায় আক্রান্ত শিশুদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সনত কুমার বড়ুয়া। এই চিকিৎসকের মতে- বিভিন্ন জটিলতা থাকলেও শিশুরা হয়তো ঠিকমতো বলতে পারছে না। যার কারণে শিশুর জ্বর হলেও অভিভাকরা দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। অথবা অবস্থা খুব খারাপ হলে তখনই শিশুকে হাসপাতালে আনা
হচ্ছে। এসব কারণে হাসপাতালে আনার পরও অনেক শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।
একই অভিমত দিয়ে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ বলছেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা যেটি দেখছি, বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গুসহ কোন টেস্ট না করে রোগীকে বাসায় রাখা হচ্ছে। এরপর অবস্থা খুব খারাপ হলে তখন রোগীকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে আমরা এরকম তথ্য পাচ্ছি। শুধু দেরি করার কারণেই এবং শুরু থেকে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীও বলছেন, অন্যান্য দেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ আছে। কিন্তু সেসব দেশে মৃত্যুর হার খুবই কম। আমাদের এখানে মানুষের অসচেতনতায় মৃত্যু বাড়ছে। ৪/৫ দিন জ্বরে ভুগলেও মানুষ ডেঙ্গু টেস্ট করায় না। ফলে অবস্থা খারাপ হলে তখন হাসপাতালে নেয়া হয়। অর্থাৎ হাসপাতালেও নেয়া হচ্ছে দেরিতে। আর এই বিলম্বের কারণেই অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র জ্বর (যা টানা ৪/৫ দিন অথবা একবার কমে আবারো আসতে পারে), বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। এসবই ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ।
জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই ডেঙ্গু (এনএস-ওয়ান) টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লেও সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়েনা। তবে কিছু অ্যালার্মিং উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অ্যালার্মিং উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- তীব্র জ্বরের সাথে পেট ব্যথা, বমি, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ, প্রস্রাব-পায়খানায় বা অন্য কোন ভাবে রক্ত যাওয়া। এসব অ্যালার্মিং উপসর্গের পাশাপাশি রক্তের প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলে এবং হেমাটোক্রিট (এইচসিটি) স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
শিশুর ক্ষেত্রে জ্বর দেখা দিলেই ডেঙ্গু টেস্টের পাশাপাশি রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সনত কুমার বড়ুয়া। বিশেষ করে প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিট (এইচসিটি) পরীক্ষা করা জরুরি জানিয়ে ডা. সনত কুমার বড়ুয়া বলেন, জ্বরের তিন দিনের মধ্যেই অবশ্যই এই টেস্ট করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে অবশ্যই প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিট (এইচসিটি) পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এইচসিটি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়ে গেলেই রোগীর অবস্থার অবনতি হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। তখন দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। শিশুরা যেহেতু সবকিছু ঠিকমতো বুঝাতে অপারগ, সবচেয়ে ভালো হয় শিশুর জ্বরের পরপরই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসকের।
এদিকে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের টানা ৫/৬ দিন তীব্র জ্বর থাকতে পারে জানিয়ে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার বলেন, ৫/৬ দিন পর জ্বর নেমে যেতে পারে। তবে জ্বর নামলেও জ্বরের ৬ থেকে ১০ দিনের সময়কালটি রোগীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় রক্তের প্লাটিলেট অতিমাত্রায় কমে যেতে পারে। ফলে এই সময়ে অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। প্রয়োজনে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার।
পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে বেশি বেশি তরল জাতীয় (পানীয়) খাবার খাওয়াতে হবে। জ্বর থাকলে শুধু সাধারণ প্যারাসিটামল চলবে। আক্রান্ত রোগীর সিবিসি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত রক্তের প্লাটিলেট ও এইচসিটি মনিটর করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। রোগীকে এসময় তরল জাতীয় খাবার (জুস, ডাবের পানি, স্যালাইন, স্যুপ প্রভৃতি) বেশি বেশি খাওয়াতে হবে। পরিবারের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গতকালের আগের ২৪ ঘণ্টায়ও নতুন করে ৯৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। আর বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে ১৪০ জন। সবমিলিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত) চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৪০ জনে।
আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। হিসেবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারির সময়ের তুলনায় চলতি বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি চট্টগ্রামে। ২০১৯ সালে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় (চমেক হাসপাতালের তথ্যসহ) ২ হাজার ৫৪৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় অন্তত ৭ জনের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসএসসির ফল ২৮ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে
পরবর্তী নিবন্ধইসলামের মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী