আকাশ-ভরা স্বপ্ন

রিনিক মুন | বুধবার , ১ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

তীর্য একেবারে ছোট্ট ছেলে। বয়স দশ কি এগারো। চোখ দুটো সবসময় ঝিলমিল করে, আকাশের তারার মতো।

কিন্তু তীর্যের জীবনে কোনো বই নেই, খাতা নেই, স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি তার কানে বাজে না কখনো।

প্রতিদিন ভোর হলে সে বেরিয়ে পড়ে শহরের রাস্তায়। কারো জুতো পালিশ করে, কারো কাছে পানি বেচে, কখনো আবার লাল সিগন্যালের ভিড়ে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

তার বুক ভরা একটা স্বপ্ন আছেএকদিন সেও বই হাতে স্কুলে যাবে।

একদিন বিকেলে শহরের পার্কের পাশে সে বসেছিলো। আকাশ তখন রঙ বদলাচ্ছিলোনীল থেকে সোনালি, সোনালি থেকে লাল।

তীর্য চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। তার চোখে যেন অদ্ভুত এক আলোর খেলা।

ঠিক তখনই এক স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি তার পাশে এসে বসলো। হাতে চকচকে ব্যাগ, ভেতর থেকে বের হলো রঙিন খাতাকলম।

তীর্যের চোখ আটকে গেল। সে ফিসফিস করে বলল

এই দাগগুলো তো ছোট ছোট ছবির মতো, তাই না? এরা সবাই মিলে কত কিছু আঁকেৃ কত গল্প বলে।”

স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি অবাক হয়ে তাকালো

তুমি চিনো না এগুলো?”

তীর্য মাথা নেড়ে বলল

না। কিন্তু আমার মনে হয় এরা জাদুর মতো। যদি আমি পড়তে পারতাম!

তার গলা থেমে গেল চোখে ভাসলো এক অদৃশ্য জলরেখা।

স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি কিছু না বলে খাতার পাতা খুলল। তারপর নিজের কলম দিয়ে বড় করে লিখে দিল

অ”

সে বলল

এটা ‘অ’। এটা দিয়ে কত নাম, কত শব্দ লেখা যায়অজ, অলি, অভি অরুণ”

তীর্য সেই দাগের বাঁক ছুঁয়ে দিল আঙুল দিয়ে। তার মনে হলো, এই ‘অ’ যেন দরজা খুলে দিল নতুন এক দুনিয়ার।

সেদিন থেকে প্রতি সন্ধ্যায় স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি স্কুল থেকে ফিরে পার্কে আসে। তীর্যকে শেখায় অ, , ,

তীর্যের চোখে তখন আর ক্লান্তি নেই, ভিক্ষার অভিমান নেইশুধু আছে আকাশ ভরা স্বপ্ন।

একদিন তীর্য মাকে গিয়ে বলল

মা, আমি পড়তে চাই। আমি বই হাতে স্কুলে যেতে চাই। তুমি রাজি তো?”

তীর্যের মা, যে প্রতিদিন দিনমজুরির পর ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে, ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন

তুই যদি শিখিস, সেটাই হবে আমার আলো।”

তার চোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রু,

কিন্তু সেই অশ্রু ছিল না দুঃখের।

ওটা ছিল আলোতে ভরা এক নতুন ভোরের অশ্রু।

পরের দিন পার্কে দেখা হলে তীর্য সেই কথাটা জানাল স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিকে,

স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি ছুটে গিয়ে মাকে বলল

মা, তীর্য সত্যিই পড়তে চায়। তুমি তো স্কুলে পড়াও, তুমি কি ওর জন্য কিছু করতে পারো না?”

শিক্ষিকা মা মৃদু হেসে বললেন

যে শিশু শিখতে চায়, তার পথ কেউ বন্ধ করতে পারে না। এসো, আমরা একসাথে ওর হাত ধরে দিই অক্ষরের আলো।”

এরপর থেকে তীর্য শুধু পার্কেই নয়, সন্ধ্যায় সেই শিক্ষিকার ছোট্ট টেবিলে বসতে লাগল। খাতায় অক্ষর ভরতে ভরতে সে স্বপ্ন দেখতএকদিন সে ডাক্তার হবে, কবি হবে, শিক্ষক হবে

বছর গড়িয়ে তীর্য ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল।

কিন্তু বড় হতে হতে সে এক জিনিস ভুলল নাঅক্ষরের প্রথম আলোকে দিয়েছিল তাকে, আর কেমন করে সেই আলো তার জীবন বদলে দিয়েছিল। একদিন তীর্য শহরের আরও অনেক পথশিশুকে জড়ো করল।

মায়ের আর সেই শিক্ষিকার সহায়তায় গড়ে তুলল ছোট্ট এক সন্ধ্যাকালীন স্কুল।

ফুটপাতের ধুলোয়, ভাঙা টেবিলে, কিংবা পার্কের বেঞ্চে বসেই শুরু হলো ক্লাস

যেখানে বই খুলে প্রথম অক্ষর শিখে নিল আরও অনেকে।

শহরের বাতাসে ভেসে উঠল নতুন স্বপ্নের গন্ধ।

একটি অক্ষর, একটি খাতা, অথবা সহৃদয় মানুষের হাতপথশিশুদের জীবনেও জ্বালাতে পারে নতুন আলো।

পার্কের বেঞ্চে, সেই শিক্ষিকার হাত ধরে বসে থাকা ছোট্ট শিশুরা তাকিয়ে আছে আকাশের তারার দিকে।

রাতের নীরবতা যেন আলোর কথা শুনছে।

তীর্য মায়ের কোলে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল

মা, একদিন শুধু আমি নই, আমার মতো হাজারো পথশিশু আকাশের মতো বড় হবে।

তারা নিজের অক্ষর আঁকবে, নিজের স্বপ্ন লিখবে, নিজের আলো জ্বালাবে।

আর তখন তুমি গর্ব করে বলবেএই তীর্য শুধু তোমার ছেলে নয়, অনেকের আলো।”

ছোট্ট হাতে কলম, আলোকবর্তিকা শিক্ষিকার হাত, স্বপ্নময় চোখমিলে জন্ম দিচ্ছে এক নতুন দিনের আলো।

শহরের প্রতিটি পথ, ফুটপাত, পার্কসব জ্বলে উঠল সম্ভাবনার আলোতে,

আর পথশিশুরা দেখছে, তাদের আকাশ এখন আর অন্ধকার নয় আলোয় ভরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশরৎ রানী স্বপ্ন বোনে
পরবর্তী নিবন্ধবিভিন্ন স্থানে শারদীয় উপহার বিতরণ