আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি ‘বেলতলায়’ যাবে না

চট্টগ্রামে বিভাগীয় শ্রমিক দলের সমাবেশে ফখরুল

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৭ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আবারো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ বকের মতো ফাঁদ পেতেছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে এ ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি আর ‘বেলতলায়’ যাবে না বলেও ঘোষণা দেন তিনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ প্রশাসন সাজাচ্ছে বলে অভিযোগ করে তিনি দাবি করেন, বিদেশিরা বাংলাদেশে আসায় আওয়ামী লীগ ‘ভালো’ সাজে। এ সময় তিনি সরকারের প্রতি ‘মানুষকে বোকা বানানোর খেলা থেকে ক্ষান্ত দেয়া’র জন্য এবং মানে মানে সরে যাওয়ার আহ্বান করেন। বলেন, কোনো মসনদই স্থায়ী নয়। বন্দুক দিয়ে, মামলা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। তিনি সরকারের পদত্যাগে বিএনপির পূর্ব ঘোষিত এক দফা দাবি আবারও তুলে ধরেন। এ দাবি আদায়ে আগামী ১৯ জুলাই সারা দেশে পদযাত্রা হবে ঘোষণা দিয়ে বলেন, এটা মার্চ ফর ভিক্টোরি। অর্থাৎ বিজয়ের জন্য যাত্রা।

গতকাল বিকালে নগরের নাসিমন ভবন দলীয় কার্যালয়ের সামনে নুর আহম্মদ সড়কে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের ‘দেশ বাঁচাতে শ্রমজীবী মানুষের জাগরণ’ শীর্ষক শ্রমিক মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। প্রধান বক্তা ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ হচ্ছে বকধার্মিক। বক নদী, বিলে এক পা দিয়ে মাথা নিচু করে একদম চুপ করে বসে থাকে। যেন তার মতো ভালো পাখি আর নেই। কিন্তু যেই একটা মাছ নিচ দিয়ে যায় টুপ করে খেয়ে ফেলে। আওয়ামী লীগও চুপ করে বসে আছে। আবার নতুন করে ফাঁদ পেতেছে, যাতে টুপ করে আবার ক্ষমতায় চলে আসতে পারে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে যায় না। ভোটই হয় না, যাবে কেন? আবার আওয়ামী লীগ বলে সুষ্ঠু ভোট হবে। মানুষ হাসবে নাকি কাঁদবে। ভূতের মুখে রাম রাম। যার মাথায় চুল নেই সেকি বারবার বেলতলায় যায়? না। আমরা কি আবার ওই বেলতলায় যাব? এরা আমাদের বেলতলায় নিয়ে যেতে চায়।

তিনি বলেন, বিদেশিদের সামনে আওয়ামী লীগ দেখাচ্ছে, আমরা ভালো হয়ে গেছি, বিরোধী দলকে মিছিলমিটিং, আন্দোলন করতে বাধা দিই না। কোনো হয়রানি করছে না। সারা দুনিয়াকে বোঝাতে চায়, আমরা ভালো হয়ে গেছি। বিদেশিরা আসার পর কোথাও হামলামামলার খবর পাইনি। আমরা নোয়াখালী গিয়েছিলাম, লাকসামে একটু মারধর করেছে আর কোথাও করে নাই। ঢাকায় মিটিং করলাম, দুয়েকটা জায়গা বাধা দিয়েছে, খুব বেশি মারামারি করে নাই। তারা বিদেশিদের দেখাচ্ছিল, আমরা কত ভালো। বিরোধী দলকে সভা করতে দিই, তাদের বাধা দিই না। কিন্তু যেই সময় আসে টুপ করে ধরে। এখন আবার শুরু করেছে। মার্কিনিরা যাওয়ার পর গতকালই লাকসামে ৬০ জনকে আহত করেছে। কুমিল্লা উত্তরের সভাপতিকে আহত করেছে। তিনি হাসপাতালে ভর্তি। ঝিনাইদহে হাতের কবজি কেটে নেয়া হয়েছে।

ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ আবারো পরিকল্পনা করছে হেনতেন প্রকারে, যে কোনো কৌশলে কীভাবে ক্ষমতাকে আবার দখল করা যায়। এজন্য তারা প্রশাসনকে সাজাচ্ছে। ডিসি, যারা নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হয় তাদের ৩৬৩৮ জনকে সম্প্রতি পোস্টিং দিয়েছে। তাদের মন্ত্রীদের যে পিএস, এপিএস তাদেরকে ডিসিএডিসি বানাচ্ছে। ইউএনও বানাচ্ছে তাদের পছন্দের লোককে।

তিনি বলেন, সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য এতই পাগল হয়ে গেছে, বিচারকদের চিঠি দিয়ে জানাচ্ছে সমস্ত পেন্ডিং মামলা শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছিল সেগুলো শেষ করতে। আমরা নাকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ট্রাক চুরি করেছিলাম। আমি ১ নম্বর আসামি। দুই অজ্ঞাত যুবক মোটরসাইকেল থেকে বোমা মেরে চলে গেল, এটা নাকি মহাসচিবের পরিকল্পনায় হয়েছে। কি অদ্ভুত কাণ্ড! ধরতেই পারল না, কারা বোমা মারছে তাও বলতে পারল না। কিন্তু জানল মহাসচিবের হুকুমে এটা হয়েছে।

সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আর কত বোকা বানাবেন মানুষকে? দয়া করে এ খেলায় ক্ষান্ত দেন। ক্ষমতায় বহুদিন ছিলেন। আবার যদি জনগণ ভোট দেয় ক্ষমতায় আসবেন। দয়া করে জনগণকে একবার ভোট দেয়ার সুযোগ দেন। মানে মানে এখনো ভালোই ভালোই দেন। না দিলেও দেশের জনগণ জানে কি করে তা আদায় করে নিতে হয়। সবসময় ভয় দেখিয়ে, মামলা দিয়ে, বন্দুক দিয়ে কাজ হবে না। অনেক করেছেন।

ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ ফখরুদ্দিন, মঈনুদ্দিনের সঙ্গে গোপন সন্ধি করে জোর করে ক্ষমতায় বসেছিল। সেদিন থেকে এদেশের জনগণ আন্দোলনে নেমেছে। আন্দোলন এখনও চলছে। দেশের মানুষকে মুক্ত করার, গণতন্ত্রকে মুক্ত করার আন্দোলন এখনও চলছে।

তিনি বলেন, আমরা পরিবর্তন চাই। এজন্য রাস্তায় নেমেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন এমপি সংসদে গিয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের আঁধারে ভোট চুরি করে ক্ষমতা দখল করেছে। ২০২৪এর যে নির্বাচন আসছে, দয়া করে মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না। মানুষকে তার ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে দেন। এই সমস্যা শুধু খালেদা জিয়ার না, বিএনপির না, তারেক জিয়ার না। এই সমস্যা আজ পুরো জাতির। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করছিলাম একটি স্বাধীন, মুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য। আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু সবকিছু থেকে বাংলাদেশের মানুষ বঞ্চিত হয়ে গেছে শুধুমাত্র একটি কারণে। একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার ও একটি দল ক্ষমতাকে নিজেদের কাছে চিরস্থায়ী করতে চায়।

নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, তারা কথায় কথায় বলে, খুব সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে সে রকম নির্বাচন দেব। কোনো দলকে প্রভাব বিস্তার করতে দেব না। তারা পারবে সবকিছু। আসলে তারা কোনোকিছুই পারবে না। তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। আগে যেখানে ইচ্ছে সেখানে নির্বাচন কমিশন হস্তক্ষেপ করতে পারত, এখন সেটা তারা পারে না। নির্বাচন কমিশন এখন ঠুঁটো জগন্নাথ।

ফখরুল বলেন, একটি হচ্ছে লুটেরাদের ভাগ, যারা ক্ষমতার বলে জনগণের টাকা লুট করে খাচ্ছে, বাংলাদেশকে লুট করছে, শোষণ করছে। আরেক ভাগ সাধারণ মানুষ, যারা এসব লুটেরাদের খপ্পরে পড়ে কষ্টে দিনযাপন করছে। চট্টগ্রামে একটি টানেল হয়েছে। নদীর তলদেশে রাস্তা হাতেগোনা কয়েকটি দেশেই আছে। টানেল আমাদের দরকার, আমরাও খুশি। টানেলে আপত্তি নেই। কিন্তু আমার ৮০ ভাগ লোক ১০ টাকায় কেজি দরে চাল খেতে পারছে না। এই ৮০ ভাগ লোক যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাদের জন্য সরকারি হাসপাতাল করা হয় না, সরকারি স্কুল করা হয় না। গত ১৫ বছরে কয়টি সরকারি স্কুল, হাসপাতাল হয়েছে খোঁজ নেন। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার সবাইকে শোষণ করেছে, এখন ২২ হাজার পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। এরাই দেশের সব মানুষকে এখন শোষণ করছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ কখনও মাথা নোয়ায়নি। মাথা উঁচু করে সব আন্দোলন, সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। এই মাটি থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এই মাটি থেকে মাস্টারদা, প্রীতিলতা বিদ্রোহ করেছেন। এই মাটি থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। এখান থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বর্তমান অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম পথ দেখিয়েছে। এক দফা দাবি, সরকারের পতনের দাবি আদায় করেই চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশবাসী ঘরে ফিরে যাবে।

সমাবেশে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু ও মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ নেতৃবৃন্দ।

বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, আজকের সমাবেশ প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। ২০১৮ সালে তারা প্রশাসনের মাধ্যমে ভোট চুরি করে ক্ষমতায় এসেছে। এরা লুটেরা সরকার। মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে মেগা দুর্নীতি করে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। আমরা তাদের বিচার করব। যারা লন্ডনে বাড়ি করেছে তাদের বিচার হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন গণভবন ছাড়তে হলে উনি কোথায় গিয়ে থাকবেন। আমি বলি জনগণ যদি গণভবন থেকে বের করে দেয় তাহলে আপনার স্বামী ওয়াজেদ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। বেগম খালেদা জিয়াকে নাজিম উদ্দিন রোডের যে জেলখানায় রেখেছেন সেখানেই হবে আপনার ঠিকানা।

অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, বিএনপি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই চট্টগ্রাম থেকে শ্রমজীবী মানুষের মহাসমাবেশ শুরু করেছে। চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে দিকনির্দেশনা দেবে। আমাদের এ লড়াই শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার করবে। বিএনপির নেতৃত্বে ৩৭ দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। শেখ হাসিনার বিদায় অনিবার্য। চলে যেতেই হবে।

সমাবেশে রাখেন কেন্দ্রীয় বিএনপির উপজাতি বিষয়ক সম্পাদক মা ম্যা চিং, সহসাংগঠনিক সম্পাদক জালাল উদ্দিন মজুমদার, হারুনুর রশিদ ভিপি, সহশ্রম সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান, ফিরোজ মামুন মোল্লা, কঙবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, সাচিং প্রু জেরী, সাথী উদয় কুসুম বড়ুয়া, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম, উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ হালিম, বিভাগীয় শ্রমিকদলের সিনিয়র সহসভাপতি ইদ্রিস মিয়া, মহানগর শ্রমিকদলের সভাপতি তাহের আহমেদ, দক্ষিণ জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যান, নোয়াখালী জেলা শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন, উত্তর জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি মোতালেব চৌধুরী, কঙবাজার জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম ও খাগড়াছড়ি জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আসলাম কালু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির আন্দোলন বিদেশিদের ওপর ভর করে : কাদের
পরবর্তী নিবন্ধভোট চোরের আস্তানা ভেঙে দিতেই বিদেশিরা বাংলাদেশে আসছে : খসরু