আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয়ক্ষমতায়ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের আজকের এই অবস্থা দেখে কল্পনাও করা যাবে না পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে কি কঠিন পরিস্থিতিতে এম. এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, শহীদ শেখ মোজাফ্ফর আহমদ, মৌলানা এ আর চৌধুরী এবং আমীর হোসেন দোভাষ প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রামে আওয়ামী রাজনীতির বীজ বপন করেছিলেন। এম এ আজিজদের উত্তরসূরি হিসেবে যারা চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিকে ফুলে ও ফসলে বিশাল মহীরুহে পরিণত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে দুঃসাহসী, স্পষ্টবাদী রাজনৈতিক নেতা ইসহাক মিয়া অন্যতম। চট্টগ্রাম সবার অগ্রে। মহাত্মা গান্ধীর এ অমীয় বাণী চট্টগ্রামকে করেছে আরো দেদীপ্যমান। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী চট্টগ্রাম। যুব বিদ্রোহ প্রজ্জ্বলিত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার খ্যাত তিন দিনের স্বাধীনতা ভোগকারী চট্টগ্রাম। ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘ম্যাগনাকার্টা খ্যাত বাঙালির মুক্তির অবিনাশী সনদ ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ–অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রয়েছে চট্টগ্রামের অভূতপূর্ব অবদান। চট্টগ্রাম বঙ্গবন্ধুরই চট্টগ্রাম। এম. এ আজীজ, জহুর আহমদ চৌধুরী পরবর্তী চট্টগ্রামের রাজনীতির আওয়ামী ইতিহাসে কালক্রমে বিপুল সংখ্যক নেতা–কর্মীর আবির্ভাব এবং আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্কর চট্টগ্রামের পান্ডুলিপি। আওয়ামী রাজনীতির ধারাবাহিকতার সহজ সরল ও দৃঢ়চেতা রাজনীতিক, ত্যাগ–প্রজ্ঞা ও সংগ্রামের নন্দিত প্রতীক জননেতা ইসহাক মিয়া।
১৯৩০ এর ১ মে উত্তর আগ্রাবাদের হাজী পাড়ায় এ লড়াকু রাজনীতিকের জন্ম। পিতা– জোনাব আলী ও মাতা তামিজা খাতুনের নন্দিত সন্তান তিনি। ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে যোগদেন। ইসহাক মিয়ার রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষাগুরু চট্টগ্রাম শহরের কিংবদন্তি নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী। তাঁদের কাছে থেকেই তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। রাজনৈতিক যোগ্যতায় এ দুই কিংবদন্তি নেতার সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। তাঁদের সংস্পর্শে থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বহুবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে তাঁর। ১৯৫৩ সালে এম. এ আজিজ, এন জি মাহমুদ কামাল, তারেক আহমদ চৌধুরী সহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের সুযোগ হয়। পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাাম শহরে আসেন।
সে সময় ইসহাক মিয়া ব্যক্তিগত জীপ গাড়ি করে বঙ্গবন্ধু, এম এ আজিজ, এন জি মোহাম্মদ কামাল, তারেক আহমদ চৌধুরী, শেখ মোশারফ হোসেন, আবুল কালাম, এম এ গণি, ফজলুল হক সহ মাইজভান্ডার জিয়ারত করেন। সেই গাড়ির নম্বর ছিল EBD 16-84। যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু সবাইকে উদ্দেশ্য করে দেশের উন্নয়নের বিষয়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন, যা সকলে আমৃত্যু মনে রেখেছেন।
১৯৫৬ সালে জনপ্রতিনিধি হিসেবে অবিভক্ত আগ্রাবাদে ওয়ার্ডের নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সে সময় আগ্রাবাদ ছিল একটি ইউনিয়ন, তখন মাঝখানে ছিল বিশাল বিল, ধানী জমি–চাষাবাদের জন্য যেখানে জোড়ায় জোড়ায় হালচাষের বলদ, মহিষ দাঁপিয়ে বেড়াতো। দক্ষিণ পাশে ছিল ডাকাতিয়া বিল। আক্ষরিক অর্থেই সেখানে ডাকাতি হতো। ইসহাক মিয়া জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এ এলাকায় সভ্য জীবনের বুনিয়াদ গড়ে তোলেন। – নিম্ন পর্যায় থেকে স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি করার কারণে জনগণের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল। এলাকার উন্নয়ন, সমস্যার সমাধান, জনগণের অভাব–অভিযোগ মোচনে তিনি সব সময় সোচ্চার ও তৎপরে থেকেছেন। ১৯৫৬, ১৯৯৬২ ও ১৯৬৬ সালে যথাক্রমে আগ্রাবাদের কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহ প্রজেকশান মিটিংয়ে মারামারিতে ইসহাক মিয়া গুরুতর আহত হন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৬৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা ও বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৬৬ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতির মুক্তির সনদ জাতির ম্যাগনাকাটা, ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ইসহাক মিয়া সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোয়ন বন্টনের সময় চট্টগ্রাম–৮ থেকে বহু নেতা প্রার্থী হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজ দায়িত্বে এবং নিজ কন্ঠে পার্লামেন্টারি বোর্ডে বলেন, ‘চট্টগ্রাম–৮ আসনের একটি মনোনয়ন আমি ইসহাককে দিলাম। বাকীগুলো তোমরা দিয়ে দিও।’ বঙ্গবন্ধুর নিজ দায়িত্বে ইসহাক মিয়াকে মনোনয়ন দেওয়াটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরে বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মীসহ চট্টগ্রামে আসেন। জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান সহ সকলে ইসহাক মিয়ার বাড়িতে দুপুরের খাবার খান। তখন চট্টগ্রাম শহরের সব আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম–৮ (বন্দর–পতেঙ্গা–ডবলমুরিং) আসনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসহাক মিয়া এ আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগকে মহানগর তথা জেলা পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চট্টগ্রাম মহানগরের গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিল এবং চট্টগ্রাম মহানগরকে জেলা কমিটির মর্যাদা প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে তিনি মহানগরের সাংগঠনিক বিভিন্ন পদে থেকে কাজ করেছেন।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২৬ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ফোনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি তাঁর নিকট পৌঁছান। ইঞ্জিনিয়ার মোশারফের নির্দেশনা অনুযায়ী অস্ত্রভর্তি সোয়াত জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে ৫০০/৬০০ লোক নিয়ে ঘেরাও করে রাখেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানী হানাদাররা এলাকায় ক্যাম্প করলে তিনি যুদ্ধের রণকৌশল হিসেবে এলাকা ত্যাগ করেন এবং গোপনে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয়।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশ গঠনে অংশ নেন। চট্টগ্রাম বন্দরের মাইন–সুইপিং নিমজ্জিত জাহাজ উদ্ধার কার্যক্রম তদারকিকরণ এবং বন্দর চালু করার যাবতীয় কার্যক্রম দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন। বন্দরের কর্মকর্তা আমার বড় ভাই ফরিদ আহমদ বন্দরের কর্মকর্তা হিসেবে মাইন–সুইপিং ও নিমজ্জিত জাহাজ উদ্ধার করে বন্দরকে সচল করার দায়িত্ব পালন করেন এবং দক্ষতার সাথে এ কাজে তিনি সফলতা লাভ করেন। পরবর্তীতে রাশিয়ান সেলভেজ টিমের সাথে কাজ করেন। বঙ্গবন্ধু কাজের পুরস্কার স্বরূপ ফরিদ আহমদকে পুরস্কৃত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ইসহাক মিয়াকে চট্টগ্রাম সমাজকল্যাণ ও শিশু কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন এবং চট্টগ্রাম শহরে রেশনসপ্ এর বরাদ্দ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। আমদানি রপ্তানি সংক্রান্ত লাইসেন্স প্রদান মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি কৃতিত্বের সাথে পালন করে প্রশংসিত হন।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির ক্রান্তিকাল! জাতির কতিপয় কুলাংগার সন্তান রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যান। সে সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ তাঁকে অস্থির করে তোলে। ১৯৭৬ এ জাতির জনকের হত্যার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দেশ অবরুদ্ধ রাজনীতি হতে মুক্ত হলে ১৯৭৯ এর নির্বাচনে চট্টগ্রাম–৮ আসন হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম–৮ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হয়রানির মাধ্যমে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ৬ মাস তিনি কারাভোগ করেন।
ইসহাক মিয়া ছিলেন প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগের প্রাচীন ধারার একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তিনি দুঃসাহসী ও স্পষ্টবাদী নেতা ছিলেন। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তিনি কিছু পাওয়ার চেষ্টা করেননি। সকল প্রকার আর্থিক লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অনৈতিক ও অপকৌশলের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কোন মোহ তাঁকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার কর্ম চট্টগ্রামবাসীকে সব সময় প্রাণবন্ত রেখেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও ত্যাগী এ নেতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। তিনি ইসহাক মিয়াকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছেন। ইসহাক মিয়ার সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয় হলো তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে তাঁর স্বাক্ষর বিদ্যমান। গণপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য,বঙ্গববন্ধুর একনিষ্ঠ ও ঘনিষ্ঠ সহচর, সংবিধান প্রণেতা এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ইসহাক মিয়া ২০১৭ এর ২৪ জুলাই ৮৬ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ইতি ঘটিয়ে মহাপ্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। স্মরণ করি তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনীতি কর্মজীবনের। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে এ কর্মবীর রাজনীতিক ব্যক্তিত্বকে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক–শিল্পশৈলী।