আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ৪ নভেম্বর, ২০২৪ at ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ

আমরা কিন্তু তখন কানে শুনতাম, চোখে স্বপ্ন দেখতাম। কানে শুনে বিশ্বাস করতাম, সেটা বাজাতাম। আর চোখে স্বপ্ন দেখতাম এগিয়ে যাবো”আর এভাবেই চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া সত্তর দশকের এক কিশোর গানের জগতে প্রবেশ করে এবং চর্চা করতে করতে সারা দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে। সেই কিশোরই হয়ে গেল পরবর্তীতে একজন সফল গিটারিস্ট, সুরকার, গায়ক এবং সংগীত পরিচালক। তিনি আইয়ুব বাচ্চু। এবি। উপরের কথাগুলো নিজেই বলেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু এক সংগীত আড্ডায়।

আইয়ুব বাচ্চু নামটি আজ বাংলাদেশের ব্যাণ্ড সংগীতের ভুবনে এক গৌরবময় অধ্যায়ের নাম। কী নিরলস প্রচেষ্টায় সংগীত সাধনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন, বলতে গেলে গবেষণার বিষয়। যে কিশোর চট্টগ্রামে আজম খানের একটি কনসার্ট দেখে ঠিক করেছিলেন সংগীতশিল্পী শিল্পী হবেন। প্রয়াত লিড গিটারিস্ট নয়ন মুন্সির বাজনা দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও লিড গিটার বাজাবেন। আর এভাবেই যাত্রা শুরু একজন কিশোর আইয়ুব বাচ্চুর। বহুমুখী প্রতিভাধর এই শিল্পী ছিলেন তারুণ্যের বাঁধভাঙা জোয়ার। সেই জোয়ারের ঢেউয়ে ভেসে চলেছে আজও তারুণ্য।

কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু আকস্মিক আমাদের ছেড়ে গেলেন ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখ। রেখে গেলেন বিশাল কর্মযজ্ঞ। আইয়ুব বাচ্চুকে বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের বরপুত্র। তাঁর মতো এমন প্রতিভাধর শিল্পী আর পাইনি আমরা। আইয়ুব বাচ্চুর সৃষ্টিকর্মকে যথাযথভাবে সন্নিবেশ করে একটি মূল্যবান প্রকাশনা করেছেন এই প্রজন্মের আরেক গায়ক ও লেখক জয় শাহরিয়ার। যিনি আইয়ুব বাচ্চুর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর সৃষ্টিকে। জয় শাহরিয়ার আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই সম্পাদনা করেছেন “রুপালি গিটার” নামে একটি বই। এই বইতে আছে দশটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ, একটি সাক্ষাৎকার এবং ডিস্কোগ্রাফি।

যাঁরা লিখেছেন তাঁরা এই বরেণ্য সংগীত শিল্পীকে দেখেছেন কাছ থেকেই। কীভাবে সংগ্রাম করে সংগীত তারকা হলেন, তাঁদের লেখায় সেই কাহিনী জানতে পারি। যাঁরা লিখেছেন তাঁরা হচ্ছেন : শহীদ মাহমুদ জঙ্গী (বাচ্চুর সেই সময়), নকীব খান (বাচ্চুকে মনে পড়ে), কুমার বিশ্বজিৎ (বাচ্চু আমার বন্ধু), সাইদ হাসান টিপু (আইয়ুব বাচ্চু : রুপালি গিটার ফেলে), হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল (আমি অবাক হয়ে যাই), বাপ্পী খান (এবি রোমন্থন), নিয়াজ আহমেদ অংশু (আমাদের কারো কোনো কথা নেই ভালো নেই শহরের পাখিরা), আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (আমার বস: আমার অযুত আলোর ঋণ), জয় শাহরিয়ার (আইয়ুব বাচ্চু : বাংলা রকের ছায়াবৃক্ষ), মিলু জামান ও হক ফারুক (এলআরবি : বাংলা রকের কান্ডারি)। এছাড়াও আছে আইয়ুব বাচ্চুর একটি অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার। এই মূল্যবান কাজটি করেছেন আসিফ আসগর রঞ্জন। আর সবশেষে একনজরে আইয়ুব বাচ্চুর ডিস্কোগ্রাফি।

লিড গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর সুরকার হয়ে ওঠার কাহিনী আমরা জানতে পারি বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখায় (বাচ্চুর সেই সময়)। তিনি লিখছেন: বাচ্চুর সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৯/৮০এর দিকে। তার বয়স তখন ১৬১৭ হবে। ঝাঁকড়া চুল। নাদুসনুদুস শরীরের গড়ন। সোজা আমার কাছে এসে বললো, “আমার নাম বাচ্চু। আমি ফিলিংসে গিটার বাজাই। আপনার কাছে এসেছি একটি গানের জন্য। আমায় যদি একটি গান লিখে দিতেন, তবে সুর করার চেষ্টা করতাম।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বাচ্চু থামলো। এই আলাপচারিতার পরে “হারানো বিকেলের গল্প বলি” শিরোনামে তাকে একটি গান লিখে দিয়েছিলাম। পরে জানতে পারি বয়েস অল্প হলেও, ও খুব ভালো গিটার বাজায়। আর এভাবেই আইয়ুব বাচ্চুর গিটার বাজানোর পাশাপাশি সুর করার কাজটা শুরু করলেন। দারুণ মেলোডিয়াস সুর করেছেন তিনি “হারানো বিকেলের গল্প বলি” গানটিতে। সেই শুরু। তারপর সোলসএ যোগদানের পরই আইয়ুব বাচ্চুর সংগীত প্রতিভা আরো বিকশিত হতে থাকে। সোলসএর ঐ সময়ে নকীব খানের পাশাপাশি আইয়ুব বাচ্চুর সুর করা গানও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। সোলসএর পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জনে আইয়ুব বাচ্চুর অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে আইয়ুব বাচ্চুর গায়ক হবার কাহিনীটাও আরও চমকপ্রদ। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ব্যান্ড শো হবে। কোনো কারণে ঐ সময়ে সোলসএর মূল গায়ক তপন চৌধুরী দেশে ছিলেন না। দলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আইয়ুব বাচ্চু গান গাইবেন। নতুন গান লেখা হলো। শহীদ মাহমুদ জঙ্গী লিখলেন “একদিন ঘুম ভাঙা শহরে ”। ঢাকার ব্লু নাইল হোটেলে পার্থ বড়ুয়াকে সাথে নিয়ে সারারাত ধরে সুর করলেন গানটি। এবং পরদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে রেকর্ডিং করা হলো। এবং অনুষ্ঠানটি সমপ্রচার হলো। শহীদ মাহমুদ জঙ্গী লিখেছেন: “এই পরিবেশনার মাধ্যমে ব্যাণ্ডের গানের গায়ক হিসেবে অন্য উচ্চতায় উন্নীত হলো আইয়ুব বাচ্চুর অবস্থান। একই সঙ্গে বাচ্চু রক গানের এক নবদিগন্তের সূচনা করলো।” এভাবেই শুরু হলো লিড গিটারিস্ট থেকে সুরকার ও গায়ক হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুর নতুন সংগীত ভ্রমণ।

বরেণ্য সংগীত শিল্পী ও সুরকার নকীব খান তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন: “বাচ্চু শিল্পী হিসেবে অসাধারণ ছিল সবদিক থেকে। গিটারে যেমন অতুলনীয়, তেমনিভাবে অতুলনীয় ছিল সুর ও সংগীতায়োজনে। যা তার অসংখ্য সফল গানের মাঝেই প্রতিফলিত হয়েছে। গীতিকবি হিসেবেও বাচ্চু ছিল অসম্ভব প্রতিভাবান। তার টোন এবং নোট সিলেকশন ছিল দারুণ। ওর স্টেজ পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো। সব মিলিয়ে বাচ্চু ছিল একজন কমপ্লিট মিউজিশিয়ান।”

আইয়ুব বাচ্চুর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সাথী কুমার বিশ্বজিৎ। তিনিও বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় গায়ক। তিনিও খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন তাঁর বন্ধু আইয়ুব বাচ্চুকে। কুমার বিশ্বজিৎ লিখেছেন: বাচ্চুর প্রেম ছিল গিটারের প্রতি। যখনই বিদেশ যেতাম শো করতে, ঠিকই একটা গিটার কিনে ফেলতো। আমি বলতাম, “তোর এত গিটার, আবার কেন কিনিস?” ওর কথা,“ভালো লাগে। আর এককেটা তো এককেরকম।” আইয়ুব বাচ্চুর গিটার সংগ্রহ এবং গিটার কেনার নেশার বিষয়টি জানতে পারি কুমার বিশ্বজিৎএর লেখনীতে।

এভাবেই একজন আইয়ুব বাচ্চু সৃষ্টি হয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ সুর। সময়ের সাথে নিজেকে বদলেছেন। ভেঙেছেন নিজেকে। মেলোডিয়াস গানের সুরকার থেকে হয়েছেন রক ও সফট রক গানের সুরকার। আবার তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে মাথায় রেখে নিজেকে গড়েছেন নিত্যনতুন সুর সৃষ্টি করে। যা এককথায় অসাধারণ।

এই বিষয়ে হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল তার স্মৃতিচারণে বলছিলেন: বাচ্চু ভাই খুব সুনিপুণভাবে আমার জন্য একটা জায়গা তৈরি করলেন। যেহেতু আমি মান্না দে, হেমন্ত এদের গান শুনে বড়ো হয়েছি ফলে আমার মাঝে ইস্টার্ন ইনফ্লুয়েন্স ছিল। পাশাপাশি আমার ভাবনা, আ্যাটিচুয়েডে একটি পাশ্চাত্যের ছাপও ছিল। তাই তিনি দুইয়ের মিশেলে শিল্পী জুয়েলকে গড়ে তুললেন। ফলে ব্যান্ডের শ্রোতারা যেমন আমাকে গ্রহণ করলো, তেমনিভাবে সলো আর্টিস্টদের গান যারা শুনতেন তারাও পছন্দ করলেন। এই কৃতিত্ব সম্পূর্ণ বাচ্চু ভাইয়ের।”

একজন মানুষ হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু কতটা মানবিক গুণী ছিলেন, তার নিদর্শন দেখতে পাই আরেক নন্দিত গীতিকবি বাপ্পী খানের লেখনীতে। তিনি লিখেছেন: “আমার আব্বা আগস্ট মাসে মারা যান; বাচ্চু ভাইয়ের মৃত্যুর তিন মাস আগে। আব্বার জানাজার দিন তার সাথে আমার শেষ দেখা। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বস বলেছিলেন, “খালু আপনি যান। আমরাও আসছি।” তারপর আমার বড় ভাইকে ধরে খুব কাঁদলেন। শেষ কথা আমাকে বলেছিলেন, “আশেপাশের মানুষ যাই বলুক না কেন, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করবি না। নিজের লেখা গানের কথা ভুলে যাবি না।” এমনই মানবিক ও গুণী মানুষ হিসেবে আমরা পেয়েছি আইয়ুব বাচ্চুকে। বাপ্পী খান এই বিষয়টি উপস্থাপন না করলেআমরা এটি জানতে পারতাম না।

প্রখ্যাত গিটারিস্ট ও শব্দ প্রকৌশলী আব্দুলাহ আল মাসুদ লিখেছেন: “বস এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি সবার জন্য চলার পথ তৈরি করে দিতেন। তিনি আশেপাশে যাদের মাঝে প্রতিভা দেখতেন, ভালো কাজের ক্ষুধা দেখতেন সবার জন্য যদ্দুর পারতেন করতেন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি এটা করে এসেছেন এবং করে গেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। অসংখ্য শিল্পী, ব্যান্ড এবং গীতিকারের ক্যারিয়ার তৈরিতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন কোনো ধরনের চাওয়াপাওয়ার হিসেব না করে। শুধুমাত্র ভালোবাসা থেকেই তিনি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য।”

রুপালি গিটার” বইটিতে আছে আসিফ আসগর রঞ্জনের নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার। মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারি এই সাক্ষাৎকারে।

রঞ্জনের সবশেষ প্রশ্ন ছিল আইয়ুব বাচ্চুর কাছে

নিউ জেনারেশন গিটারিস্টদের প্রতি আপনার কোনো অ্যাডভাইস?” উত্তওে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, “প্লিজ ডোন্ট স্টপ ইয়োরসেলফ ফ্রম প্লেয়িং মিউজিক। জাস্ট প্লে অ্যাণ্ড বিলিভ দ্যাট ইউ আর দ্য বেস্ট।” এমন ধরনের কথা কেবল আইয়ুব বাচ্চুর মতো শিল্পীই বলতে পারেন। যিনি সবসময়ই তরুণদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। এদেশের ব্যান্ড সংগীতের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

আইয়ুব বাচ্চুকে জানতে হলে “রুপালি গিটার” পড়তেই হবে। জয় শাহরিয়ারও তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা থেকে আইয়ুব বাচ্চুকে প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করার দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন। জয়কে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। এই বইতে আরেকজন গুণী মানুষের স্মৃতিচারণা থাকলে ভালো লাগতো। তিনি হলেন চট্টগ্রামের জ্যাকব ডায়েস। যার কাছে আইয়ুব বাচ্চু গিটার বাজানো শিখেছেন। তাঁর কাছেও আছে আইয়ুব বাচ্চুর অজানা অনেক কথা।

রুপালি গিটার” নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। যেখানে একজন আইকন সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে জানার সুযোগ করে দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনির্দিষ্ট
পরবর্তী নিবন্ধরাউজান অন্নদা ঠাকুর আদ্যাপীঠ রামকৃষ্ণ সংঘে বস্ত্র বিতরণ