আইন সচেতনতা: জেনে নিন আপনার যত অধিকার

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | সোমবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২৩ at ৯:১৫ পূর্বাহ্ণ

আইন আদালতে ব্যবহৃত কিছু শব্দ সম্পর্কে জন সাধারণের ভুল ধারণা নিরসনে তা এখানে তুলে ধরা হল

তসদিক: তসদিকের অর্থ দ্বারা কোনও দলিল ভেরিফিকেশন বা এটাস্টেশন করাকে বুঝায়। তহশীলদার: খাজনা বা রাজস্ব আদায়কারী অফিসকে তহশীল বা তহশীল অফিস বলে। আর খাজনা বা রাজস্ব আদায়কারীকে তহশীলদার বলা হয়।

সেলামী: কোনও সম্পত্তি লীজ/ ভাড়া বা পত্তন নেওয়ার জন্য খাজনা / ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ নজরানা স্বরূপ দেওয়া হয় তাকে সেলামী বলে। তবে শ্রদ্ধাভাজন কোনও ব্যক্তিকে কোনও উপহার সামগ্রী প্রদান করাকেও সেলামী বলে।

ময়না তদন্ত: ফৌজদারী কার্যবিধির ৫০৯() ধারার বিধান মতে ডাক্তার মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে যে রিপোর্ট দেন তাকে ময়না তদন্ত রিপোর্ট বলে। এরিপোর্ট মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সুরতহাল রিপোর্ট:

হত্যা, আত্মহত্যা কিংবা যে কোন দুর্ঘটনা বা অপমৃত্যুর ঘটনায় সাক্ষীদের সাক্ষাতে লাশের শরীরের অবস্থা সম্পর্কে যে রিপোর্ট তৈরী করা হয় তাকে ‘সুরতহাল রিপোর্ট ’। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৪ ধারার অধীনে কোন পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে বা পাড়ার দুই কিংবা ততোধিক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির উপস্থিতিতে মৃত্যুর কারণ বের করার জন্য সরেজমিনে তদন্ত পূর্বক সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করেন। মৃত ব্যক্তির দেহের অবস্থান, জখম, অস্থিভঙ্গ, থেতলানো, আঁচরের দাগ, মচকানো, ফোলানো ও অন্যান্য জখমের বর্ণনা করে, যে উপায়ে বা অস্ত্র্ত্র কিংবা যন্ত্র দ্বারা উক্ত আঘাতের চিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, তার উল্লেখ করে মৃত্যুর দৃশ্যমান কারণ সম্পর্কে প্রণীত রিপোর্টকেই সুরতহাল রিপোর্ট বলে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৪ এবং ১৭৬ ধারায় সম্পর্কে বলা হয়েছে।

নজির: নজীর অর্থ দৃষ্টান্ত। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা উর্ধ্বতন আদালতের দৃষ্টান্ত বা নজির মেনে চলাকে প্রেসিডেন্ট বলে। অর্থাৎ এর দ্বারা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আদালত কর্তৃক উর্ধ্বতন আদালতের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা বুঝায়।

আমমোক্তারনামা: এটা এক প্রকার নিদর্শনপত্র (ডকুমেন্ট) যা দ্বারা এক বা একাধিক নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে মোক্তারনামাদাতার এজেন্ট বা প্রতিনিধি হয়ে সকল প্রকার কাজকর্ম করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। মোক্তারনামার রেজিস্ট্রিকৃত হওয়া বাঞ্চনীয়। যাকে আমমোক্তার নিয়োগ করা হয় তাকে এটর্নি বলে।

পাট্টা: এটা এক প্রকার লীজ। তবে শর্তযুক্ত। এতে মালিক তাঁর প্রজাকে জমি ভোগ করার অধিকার বর্ণনা দিয়ে থাকে। বর্তমানে পাট্টার আর প্রচলন নেই। সম্রাট শেরশাহ পাট্টা প্রবর্তন করেন।

কবুলিয়ত: মালিক বা সরকারের বরাবরে রায়ত বা প্রজা কর্তৃক মালিকের অধিকার স্বাক্ষর পূর্বক কোন দলিল দিলে তাকে ‘কবুলিয়ত’ বলে। কবুলিয়তের বিষয়টি লীজের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং লীজ গ্রহীতাই কবুলিয়ত সম্পাদন করবে। অবশ্য সে জন্য কবুলিয়তের শর্তে লীজ দাতারও সম্মতি থাকা প্রয়োজন। হস্তান্তর আইনের ১০৭ ধারা মতে লীজ দাতাও কবুলিয়তে সম্পাদন স্বরূপ স্বাক্ষর করবে। পূর্বে বিভিন্ন প্রকার কবুলিয়ত চালু ছিল। যেমন:- রায়তি, দর রায়তি, কোর্ফা ও বর্গা কবুলিয়ত। বর্তমানে ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্দোবস্ত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কবুলিয়ত সম্পাদন করা হয়ে থাকে। সম্রাট শেরশাহের আমলে এটা চালু হয়। এক কথায় ইজারা গ্রহীতা ও দাতার মধ্যে সম্পত্তি ব্যবহারে যে চুক্তিনামা হয় তাকে ‘কবুলিয়ত’ বলে।

তফসিল: ফার্সী শব্দ তফছিল অর্থে আনুক্রমিক বর্ণনা বুঝায়। জমি/ সম্পত্তির (তা স্থাবর বা অবস্থার হতে পারে) বিস্তারিত বর্ণনাকে তফছিল বলে।

পরোয়ানা: পরোয়ানা অর্থ আদালত কর্তৃক সমন, নোটিশ, ওয়ারেন্ট প্রভৃতির আদেশ নামা।

খাস: সরকারের সরাসরি অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে যে ভূমি সম্পত্তি থাকে তাকে ‘খাস মহল’ বলে। ১৯৭৩ সনে জমিদারী আওতা বহির্ভূত খাস জমি বন্দোবস্তের খাজনাদি আদায় ও ব্যবস্থাপনার জন্য জেলা কালেকটরের অফিসে (ডি.সি অফিস) খাস মহল শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এই শাখার কার্যক্রম নেই। রাজস্ব শাখা খাস মহল তথা খাস জমির বন্দোবস্ত কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে।

কানুনগো: এটা ফার্সী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ। বর্তমানে কানুনগো পদটি কয়েকটি অফিসে প্রচলিত শব্দ। রাজস্ব ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে তিনি (কানুনগো) একজন রাজস্ব অফিসারের মর্যাদার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারেন। ভূমি জরিপে তসদিকসহ আনুষঙ্গিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রম যেমনরেকর্ড হালকরণ কার্যক্রম। জোনাল জরিপ ব্যবস্থাপনায় কানুনগোগণকে উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার বলা হয়।

আমিন: এটা আরবী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস। কিন্তু ভূমি জরিপের আমিন বলতে মাঠ পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী। যিনি কিস্তোয়ার, খানাপুরী ও খানাপুরীকাম্‌ বুঝারত সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কার্যক্রম করে রেকর্ডের (নকশা ও খতিয়ান) প্রাথমিক ভিত্তি প্রণয়ন করেন। মাঠ জরিপ মৌসুমে আমিনগ সাধারণত ছয় মাসের জন্য নিয়োজিত হয়। ৩ জনের একটি দল মৌজা ভিত্তিক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। দল প্রধানকে সর্দার আমিন, অপর দুইজনকে বদর আমিন ও চেইনম্যান বলে।

দেবোত্তর: হিন্দু বিধানে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত সম্পত্তিকে দেবোত্তর বলে। দেবোত্তর সম্পত্তির খাজনা দিতে হয় না। বাংলাদেশের অনেকেই বর্তমানে দেবোত্তর সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। দেবমূর্তি বাংলাদেশে অবস্থান করলে এবং যথাযথ মালিক কর্তৃক দেবতার উদ্দেশ্যে দান করলে সেই সম্পত্তি অর্পিত হতে পারে না। দেবোত্তর সম্পত্তি যিনি দেখাশুনা করেন তাকে সেবাইত বলা হয়। ‘সেবাইতের’ উক্ত সম্পত্তি হস্তান্তরের অধিকার নেই।

ওয়াকফ লিল্লাহ: মুসলিম ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি যখন পূর্ণরূপে স্বত্ব ত্যাগ পূর্বক ওয়াকফ করেন তাঁকে ওয়াকফ লিল্লাহ বলে।

ওয়াকফ্‌: কোন মুসলমান ধর্মীয়, সমাজ কল্যাণমূলক কাজ আর্তমানবতার হিতকর সাধনে ইত্যাদি পবিত্র কাজে কোনও নিজস্ব সম্পত্তি চিরস্থায়ীভাবে দান করলে সেই সম্পত্তিকে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি বলে। যিনি সম্পত্তি ওয়াকফ করেন তাঁকে ‘ওয়াকিফ’ বলে। প্রত্যেক সুস্থ মুসলমান তাঁর স্থাবর/ অস্থাবর উভয়বিধ সম্পত্তি ওয়াকফ করতে পারেন। ওয়াকফ্‌ সম্পত্তি দেখাশুনা করার জন্য যাকে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে মোতোয়াল্লী বলে। ১০০ টাকা বা তদোর্ধ্ব মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফ করা হলে ওয়াকফ দলিল রেজিষ্ট্রি করা আবশ্যক। ওয়াকফ্‌কালে ওয়াকফকৃত সম্পত্তিতে ওয়াকিফের মালিকানা থাকতে হবে। নিরঙ্কুশ স্বত্ব দখলহীন সম্পত্তি ওয়াকফ করা যায় না। মামলার বিষয়বস্ত ওয়াকফ করা যায় না।

খারিজ দাখিলা: রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইনের বিধান অনুসারে জোত আলাদা করে নিলে যিনি আলাদা করে নেন তার নামে আলাদা জোত খোলা হয় এবং আলাদা ভাবে খাজনা নেয়া হয়। আলাদা ভাবে খাজনা নেওয়ার রশিদ বা দাখিলাকে খারিজ দাখিলা বলে। মূল জোত হতে নিজের অংশ আলাদা করে নিয়ে অন্য একটি খতিয়ান খোলাকে খারিজ বলে।

এওয়াজ নামা: বিনিময় দলিলকে এওয়াজ নামা বলা হয়।

এজমালী: একত্রিত বা অবিভক্ত সম্পত্তিকে এজমালী সম্পত্তি বলে। এজমালী সম্পত্তি মানে যৌথ কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হওয়া মাত্রই তার সম্পত্তি উত্তারাধিকারীগণের উপর বর্তায়। উত্তারাধিকারীগণের মধ্যে আইন নির্দিষ্ট উপায়ে বিভাগ বণ্টন না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সম্পত্তি এজমালী বলে গণ্য হয়।

হেবা: মুসলিম আইনে ঘনিষ্ঠজনকে দান করাকে হেবা বলা হয়। বিনিময় ব্যতীত হস্তানান্তরিত সম্পত্তিকে হেবাকৃত সম্পত্তি বলে। বর্তমানে হেবা বা দানের মধ্যে পার্থক্য আছে। হেবা করা যায় স্বামীস্ত্রী, মাবাবা, ভাইবোন, ভাইভাই, বোনভাই প্রমূখ এর মধ্যে দানের ঘোষণার মাধ্যমে হেবা রেজিস্ট্রি করতে হয়। বর্তমানে মৌখিক দান বা হেবা চলবে না। হেবার ঘোষণা রেজিস্ট্রি করতে হয়। দান যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করা যায়।

মৌরশৗ সম্পত্তি: যে সম্পত্তি উত্তারাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত তা মৌরসী সম্পত্তি নামে পরিচিত। এ সম্পত্তির সাথে খরিদা সম্পত্তির কোনও পার্থক্য নেই।

হিজানত: নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মুসলিম আইনানুসারে শিশুর দেখাশুনা ও পরিচর্যার অধিকারকে আইনের ভাষায় হিজানত বলে। হিজানত দ্বারা অভিভাবকের অধিকার সৃষ্টি হয় না।

চুড়ান্ত রিপোর্ট:

তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক তদন্তপূর্বক যখন আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না তখন তাকে মামলা দায় থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য বিজ্ঞ আদালতে সুপারিশ সহ যে রিপোর্ট দাখিল করেন তাকে চুড়ান্ত প্রতিবেদন বলে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশীট বা ফাইন্যাল রিপোর্ট দিয়ে থাকেন।

আলামত: ফৌজদারী মামলার তদন্তকালে পুলিশ কর্তৃক মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কিত যে সকল দ্রব্যাদি সিজ করা হয় সাধারণত তাকে ‘আলামত’ বলা হয়। বিচারকালে বিচারকের নির্দেশ ক্রমে আলামত আদালতে হাজির করা হয়।

বায়নামা: বায়নামা কোনও স্থাবর সম্পত্তি আদালত কর্তৃক নিলামে বিক্রয় করতঃ ক্রেতাকে নিলাম বিক্রয় চুড়ান্ত রূপে নিষ্পন্ন হওয়া সম্পর্কে যে সার্টিফিকেট প্রদান করেন তাকে বায়নামা বলা হয়। কোন স্থাবর সম্পত্তির নিলাম বিক্রয় চুড়ান্ত রূপে নিষ্পন্ন হয়ে থাকলে আদালত ক্রেতাকে দিবেন এবং এতে সম্পত্তির বিবরণ এবং ক্রেতার নাম উল্লেখ থাকে এবং নিলাম বিক্রয় চূড়ান্তরূপে নিষ্পন্নের তারিখ দেয়া থাকে।

লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতাকামী প্যালেস্টাইনীদের পাশে দাঁড়ান
পরবর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যখাতের যুগোপযোগীকরণ ও উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ প্রসঙ্গে