বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কখনও বিগত সরকারের কর্মী–সমর্থক সন্দেহে কিংবা কখনও ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আবার কখনও চুরির সন্দেহে এসব গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এসব ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, পুলিশের দুর্বলতা এবং তদন্তে ঘাটতির কারণে এসব গণপিটুনি থামানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে, পুলিশ প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব সহকারে নিয়ে বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১১ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক দেশের রূপরেখা বাস্তবায়নে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। তিনি বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব। তার এই ভাষণ সমপ্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
অন্যদিকে গত ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদরদপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর বিভাগ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সমপ্রতি কোথাও কোথাও গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যার নৃশংস ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধরনের মব জাস্টিস কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ পুলিশ বদ্ধপরিকর।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কেউ অন্যায় করলে বা অপরাধী হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তির বিচারের বিধান রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। কোন ব্যক্তি অন্যায় বা অপরাধ করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে; কোনভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।
পুলিশের সংবাদ আরো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্য পুলিশ সদরদপ্তর সকলের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছে। মব জাস্টিস বা গণপিটুনির মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পুলিশ সদরদপ্তর দেশের সকল সচেতন নাগরিকের সহযোগিতা কামনা করছে। বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
আসলে কাউকে কেবল সন্দেহের বশে অপরাধী বলে তাৎক্ষণিক জনমত তৈরি করা এবং পরে গণপিটুনি দিয়ে হতাহত করা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। সবশেষ বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে গণপিটুনির ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগে ৭ই সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ গণপিটুনিতে নিহত হন। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক গণপিটুনির ঘটনায় হতাহত হওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছে। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশিরভাগ ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও আলোচনায় না আসলে পুলিশের তেমন তৎপরতা থাকে না। সেই মামলার তদন্ত বিচার ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২০শে জুলাই সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাসলিমা বেগম রেণু নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা বেশ আলোচিত হলেও এখন পর্যন্ত ওই হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। সংবিধানে মানবাধিকার নিশ্চিত করা হলেও দেশের প্রচলিত আইন ও তদন্ত ব্যবস্থায় গণপিটুনিতে শাস্তি নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। এ কারণে গণপিটুনিতে অংশ নেয়ার অপরাধে বাংলাদেশে কারো দণ্ড হওয়ার নজির বাংলাদেশের আদালতে বিরল বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।
এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা হলো মব জাস্টিসের (গণপিটুনি) মতো ঘটনা কোনোভাবে বরদাশত করা হবে না। কেউ অপরাধ করলে আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই।
আমরাও একমত যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।