আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ

ডিসি সম্মেলন উদ্বোধনে প্রধান উপদেষ্টা । কারো রক্তচক্ষু, ধমক আমলে না নেওয়ার নির্দেশ । বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে । পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসকদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু। এটা আমাদের এখন এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। এখানে যেন আমরা বিফল না হই, কারণ এটাতেই আমাদের সমস্ত অর্জন। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন ২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। সকল নাগরিকের সুরক্ষা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এখন থেকে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করব, সেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও দেশের সকল মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করা। নারী ও শিশু এবং সংখ্যালঘুসহ সকল নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। কে কোন মতবাদে বা রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী সেটা বিবেচ্য নয়। কারণ সরকার দেশের সকল মানুষের সরকার। তাই তাকে সুরক্ষা দেওয়া আমার কাজ। খবর বাসস, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে সজাগ থাকার নির্দেশ দেন তিনি। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া মস্ত বড় দায়িত্ব। এই ইস্যুতে সারা দুনিয়া নজর রাখছে আমাদের উপরে। একটা ছোট্ট ঘটনা সারা দুনিয়ায় চাউর হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বলেছি আপনারা সংখ্যালঘু হিসেবে কোনো কিছু দাবি করবেন না, দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করবেন। কারণ দেশের নাগরিক হিসেবে সংবিধান আপনাকে যে অধিকার দিয়েছে সেই অধিকার রাষ্ট্রের কাছে আপনার প্রাপ্য। এটা দাবি নয়, আপনার পাওনা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটা নিয়ে জেলা প্রশাসকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে পারে কার জেলায় বাজারদর কতটা ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে। কোনো চাঁদাবাজি বা অন্য যেসব অসুবিধা থাকে সেগুলো দূর করতে হবে।

পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে এখন যে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগছে না, এই তথ্য মাঠেঘাটে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি হয়, এটি বন্ধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদের মতো পাসপোর্ট পাওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার।

সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করার আহ্বান জানিয়ে জেলা প্রশাসকদের অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সৃজনশীল কাজ করার সুযোগ তোমাদের পুরো মাত্রায় রয়েছে। আশা করি তোমরা সেটা গ্রহণ করবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বাজারদর নিয়ন্ত্রণ, জমির রেকর্ডপত্র থেকে শুরু করে অন্যান্য সেবা অনলাইনে প্রদান, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ সরকারি সেবাকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতা হতে পারে।

জন্মসনদ একজন নাগরিকের অবশ্যই প্রাপ্য উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে কোনো বয়সে এবং যে কোনো সময়ে একজন নাগরিক জন্মসনদ চাইতে পারে। তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জন্মসনদ একজন নাগরিকের দালিলিক প্রমাণ যে, ওই ব্যক্তি এই দেশের নাগরিক। কারণ এই জন্মসনদ দিয়েই তার অন্যান্য কাজ করতে হবে। এটা না হলে জাতীয় পরিচয়পত্র হচ্ছে না, পাসপোর্ট হচ্ছে না। জন্মসনদ পেতে একজন হয়রানির শিকার হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে।

সরকারকে একটা খেলার টিম অভিহিত করে অধ্যাপক ইউনূস জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে বলেন, সরকারকে যদি একটা ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে এটা একটি টিম। এই সরকারের ছয় মাস চলে গেল, এটাকে আমি বলছি সরকারের প্রথম পর্ব। প্রথম পর্বের কোনো ভুল থাকলে সেটাকে ঠিকঠাক করে এখন আমরা খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন কাজ হলো কর্মপদ্ধতি ঠিক করা। খেলা হলো একটা সামগ্রিক বিষয়, একজনের ভুলের কারণে অন্যরা সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। পুরো টিমের সাফল্যটা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। প্রস্তুতির কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করা দরকার।

প্রধান উপদেষ্টা জেলা প্রশাসকদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নিজের মতো করে মাঠ প্রশাসন পরিচালনা করার আহ্বান জানান। একইসাথে তিনি সরকার প্রধান বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অহেতুক স্তুতি বা প্রশংসা করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ছাবেদ আলী বক্তব্য রাখেন।

অনলাইন মানে অনলাইন, আর কিচ্ছু থাকবে না : দেশের বিভিন্ন খাত ডিজিটাইজ করা হলেও নাগরিকদের ভোগান্তি যে পুরোপুরি লাঘব হয়নি, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে মাঠ প্রশাসনকে কাজ করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শেষ বয়সে কোথাও কোথাও যেতেএকটা পাসপোর্ট দরকার। পাসপোর্ট করা হয়নি জন্মনিবন্ধন নেই বলে, জন্মনিবন্ধন লাগবে, আমার আমলে জন্মনিবন্ধন কে করত জানিও না ইত্যাদি। কিন্তু পাওয়া যায়, পয়সা দিলে ঠিকই চলে আসে; পয়সা দিলে যখন ঠিকই চলে আসে, তাহলে পয়সা না দিলেও আসার কথা। এই সিস্টেমটা আমরা করতে পারছি না কেন? এটা তো একজন নাগরিকের অবশ্য প্রাপ্য, আমার জন্মসনদ। সরকার ব্যবস্থা করতে পারেনি, এই বলে অজুহাত দিয়ে তো চলবে না। নিশ্চয়ই ব্যবস্থা আছে,- কিছু একটা করতে হবে।

নাগরিক সেবাকে কীভাবে পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে সরকারপ্রধান বলেন, ওইটা (জন্মসনদ) না হলে এনআইডি পাওয়া যাচ্ছে না, এনআইডি না হলে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না, সব আটকে গেল, সবকিছু। আমি বলছি যে, এটা সবার একইসঙ্গে তার সমস্ত কিছু হতে হবে, যদি আমার জন্মসনদ থেকে থাকে, তাহলে আমি এনআইডি পাব। এখন অনলাইনে পাওয়ার কথা। আমরা অনলাইনে পাচ্ছি কিনা, অনলাইনে এখন ইপাসপোর্ট হচ্ছে কিনা, এখনো দেখি ওই এমআরপি এমআরপি করছে। কেন হচ্ছে না? আইন তো আছে, আমি বলছি রাতারাতি সব হয়ে গেছেএটাও আমি আশা করি না; শুরু তো করতে হবে।

কারো রক্তচক্ষুধমক আমলে না নেওয়ার নির্দেশ : কাজের ক্ষেত্রে কারো রক্তচক্ষু বা ধমক আমলে না নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মাঠ প্রশাসনকে আইন অনুযায়ী দেশের জন্য কাজ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, কারও রক্তচক্ষুর কারণে, কারো ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নাই। অন্তত এ (অন্তর্বর্তী সরকারের) সময় টুকুতে। আমি নিজের মতো করে যেটাই আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার সেটা করব। সে কাজেই আমি ব্যস্ত থাকব যাতে আমি করতে পারি।

প্রসঙ্গত, এবারের সম্মেলনে ৩৪টি কার্য অধিবেশন থাকছে, যাতে ৩৫৩টি প্রস্তাব আলোচনা হওয়ার কথা। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্মেলনের শেষ দিন আগামীকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি অধিবেশনে থাকছে নির্বাচন কমিশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিক্ষোভের প্রস্তুতি চলতে থাকে সমগ্র পূর্ব বাংলায়
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্মেলন শুরু হচ্ছে আজ