স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে হয়তো সেটা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী খুব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। এ ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য এবং সহযোগিতা চাই। পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি হবে। পুলিশের মনোবল আগের চেয়ে বেড়েছে। মনোবল দুইদিনে চেঞ্জ হয় না। একটু সময় লাগে। আপনারা সময় না দিলে এটা সম্ভব না। আমার কাছে জাদুর মতো কিছু নাই যে বললেই সব হয়ে যাবে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সাথে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। যোগদান না করা পুলিশ সদস্যরা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা জয়েন করেনি তারা আমাদের চোখে অপরাধী। তাদের আইনের আওতায় অবশ্যই আনা হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের মিডিয়ার যে একটা সুনাম আছে, পাশের দেশের মিডিয়ার কিন্তু তা নাই। তারা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সবচেয়ে বেশি। আর এই মিথ্যাটাকে কিন্তু কাউন্টার করতে পারেন শুধু আপনারা (সাংবাদিকরা)। মিডিয়াকে সত্য ঘটনা প্রচার করতে হবে। আমাদের ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন। আমার একটা অনুরোধ, মিথ্যা সংবাদ দেবেন না। যেটা ঘটে নাই ওইটা বলবেন না। দেশকে অস্থিতিশীল করতে পার্শ্ববর্তী দেশের উস্কানি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), র্যাব, কোস্টগার্ড, আনসার ও ভিডিপি, বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, থানাকে জনগণের আস্থার জায়গায় পরিণত করতে হবে। জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে যেকোনো সমস্যায় থানায় যেতে পারে ও উপযুক্ত সেবা পায় থানার পরিবেশ ও কার্যক্রম সেভাবে রূপান্তর করতে হবে। থানায় সাধারণ জনগণের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তুলতে থানার কার্যক্রম আরও সক্রিয় ও যুগোপযোগী করতে হবে।
তিনি বলেন, যানজট নিরসনসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে কমিউনিটি পুলিশিংকে জোরদার করতে হবে। ইতোমধ্যে ডিএমপি এলাকায় ৭০০ জন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত সদস্য যারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের আগ্রহী সদস্যদের বয়সসীমা বেঁধে দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা চলছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি মহানগরীর যানজট নিরসনে সভা–সমাবেশের জন্য মুক্তাঙ্গন নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরীতে সভা–সমাবেশের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য মহানগরীর জন্য মুক্তাঙ্গন ঠিক করে দিতে হবে, যাতে যানজট হ্রাস পায়। এ সময় মেট্রোপলিটন এলাকায় অনুমতি ছাড়া সভা–সমাবেশ করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা প্রদান করেন।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আদালত থেকে রায় পেয়ে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিন পেয়েছে। এসব অপরাধী পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হলে সাথে সাথে তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে এবং কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচারসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধও বেড়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এই জাহাজ মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে একটা দেশে গেছে। আবার ওই দেশ থেকে আমাদের দেশে এসেছে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, আমাদের দেশে কি কোনো দেশের জাহাজ আসা নিষেধ আছে? তিনি বলেন, অনুমতি সাপেক্ষে যেকোনো দেশের জাহাজ আমাদের দেশে আসতে পারে। জাহাজটি রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথা খেজুর, পেঁয়াজ এগুলো নিয়ে এসেছে। এতে কেন আমরা বাধা দিব? তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ বিঘ্নকারী এসব ঘটনা যারা রটাচ্ছে তারা দেশের শত্রু।
সরকার পতন পরবর্তী বিভিন্ন মামলা প্রসঙ্গে মামলার আসামি হওয়া এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভুয়া মামলায় যেন কেউ হেনস্তার শিকার না হন, সেদিকে সরকার সজাগ রয়েছে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞাপন দিয়েছি বিভিন্ন মিডিয়ায়। প্রশ্নকারী ওই সাংবাদিককে লক্ষ্য করে বলেন, অ্যাকচুয়াল মামলা হলে আপনাকে ধরার কথা। এ রকম যাদের নামে মামলা আছে কাউকে কি ধরা হয়েছে? মামলা তো পুলিশ, র্যাব, আর্মি, আনসার দেয়নি। জনগণ দিয়েছে। আপনি যে কোনো হেনস্তার শিকার হননি এজন্য আমাদের আরও ধন্যবাদ দেওয়ার কথা। আগে ভুয়া মামলা করত পুলিশ। তারা ১০টা নাম আর ৫০টা বেনামি আসামি দিত। এখন জনগণ দিচ্ছে ১০টা নাম, ৫০টা বেনাম। আগে যে মামলা দিত পুলিশ এখন সেটা জনগণ দিচ্ছে।
চট্টগ্রামে সম্প্রতি সনাতন ধর্মালম্বীদের নতুন ঐক্যজোট দাবি করেছে, সরকার, রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের একটি পক্ষ দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ইন্ধন দিচ্ছে–সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটার উত্তর আপনারা সবচেয়ে ভালো দিতে পারেন। আপনি এটা লেখেন, আমরা কারো ক্ষতি করছি না। আপনারা অনুসন্ধান করে বলেন। আর উস্কানির বিষয় তো আগেই বললাম। পার্শ্ববর্তী দেশ উস্কানি দিচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ বলতে কাদেরকে বোঝানো হচ্ছে সেটা তো আপনারা জানেন।
জুলাই হত্যাকাণ্ডে চট্টগ্রামে অন্তত ৫০ জন অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সিএমপি শুধু একজন এবং র্যাব চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এমনকি অস্ত্রও উদ্ধার করা যায়নি–সাংবাদিকের দেওয়া এমন তথ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের অধিনায়ককে তাদের তালিকা করে গ্রেপ্তার করার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন।
সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম, র্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী ও জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম। সভায় সিএমপির কার্যক্রম সম্পর্কে ব্রিফ করেন অতিরিক্ত কমিশনার হুমায়ূন কবীর চৌধুরী। চট্টগ্রাম রেঞ্জের কার্যক্রম সম্পর্কে ব্রিফ করেন পুলিশ সুপার (অপারেশনস) নেছার উদ্দিন আহমেদ।