আইনশৃঙ্খলার পরিপূর্ণ স্বাভাবিকতা জরুরি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ১৭ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

সমাজসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রে স্থিতিশীলতার গতিপ্রকৃতি ও সাবলীলতাস্বাভাবিকতা নির্ধারিত হয় আইনশৃঙ্খলার যথার্থ অনুধাবন ও প্রায়োগিক কর্মকৌশলে। মূলত: দ্বন্দ্বপ্রতিযোগিতাসহযোগিতার তৌর্যত্রিক আবরণে আচ্ছাদিত থাকে সমাজ প্রবাহের অবিচ্ছেদ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ। অনগ্রসরপ্রাগ্রসর সমাজ কাঠামোয় বিধিবদ্ধ রীতিনীতিঅনুশাসন প্রতিপালনের বিপরীতে বিচ্যুতির নানামুখী বহি:প্রকাশে সামাজিক অসঙ্গতি অনুক্রমিত হয়। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাধর্মঐতিহ্যকৃষ্টিসংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট প্রচলিত মূল্যবোধআনুগত্যআস্থাসম্প্রীতিসৌহার্দের আচরণগত বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করে কৃতাহ্নিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সার্থকতা। সমাজ বা রাষ্ট্র অনুমোদিত পন্থা অনুসরণ করে জ্ঞানাঞ্জন আদর্শ প্রণয়নে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আইনের শাসন জ্ঞাপিত নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত উদ্ভূত নিয়মকানুন পরিপন্থী কর্মকাণ্ডকে যথার্থ অর্থে সংশোধনপরিমার্জন ও পরিবর্তনে আইনশৃঙ্খলার অনুকূল অনুশীলন ও পরিচর্যা মানব জীবনে গতিময়তায় অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ।

বিশ্বখ্যাত প্রায় সকল মনীষীর কন্ঠ করুণ আর্তনাদে সত্যসুন্দরকল্যাণআনন্দের ঐহিক বিপর্যস্ততা অনুরঞ্জিত হয়েছে। আদি থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের প্রজ্বলন ঘটিয়ে অশুভঅন্ধকার শক্তির নিধনকল্পে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ছিল কল্যাণমুখী অনপেক্ষ মানবিক সমাজ। কালপরিক্রমায় পরিলক্ষিত হচ্ছে একদিকে মানবসৃষ্ট আলোর প্রসারমানতা; অন্যদিকে মানুষরূপী দানবের অরাজক কুপ্রবৃত্তির হিংস্র বহি:প্রকাশ। অসাম্প্রদায়িকতামানবিকতাসৃজনশীলতামননশীলতাকে রুদ্ধ করার অপপ্রয়াস শুধু সভ্য সমাজের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেনি; বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের মুক্ত চিন্তাচেতনাধারণাকে করেছিল নিদারুণ ক্ষোভিত।

সুগভীর অন্ধকার যেমন কখনো আলোর নিগূঢ়তম বিস্তারকে আড়াল করতে পারেনি; তেমনি এগিয়ে যাওয়ার অভিযাত্রায় প্রতিবন্ধকতার কূট নির্মাণ সভ্যতাকেও স্তব্ধ করতে পরিপূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ইতিবাচক ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও যথার্থ কার্যকরী প্রয়োগ বিরূপ অবস্থানকে বিপর্যস্ত করে সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে পারস্পরিক মেলবন্ধনে গ্রন্থিত করার উদ্যোগে আইনশৃঙ্খলার অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ উন্নয়নসমগ্র নাগরিকবৃন্দের জীবনমান সমৃদ্ধকরণে আইনশৃঙ্খলার যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংরক্ষণ সমাজের উৎকর্ষ দ্যোতনা হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত। পৃথিবী নামক এই গ্রহে ক্ষুদ্রায়তনের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, বৈষম্য বিরোধী যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলন স্বল্প সময়ের মধ্যে গণজাগরণ তৈরি করে। ছাত্রজনতার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা এবং নানামুখী দমনপীড়নের ফলশ্রুতিতে সরকার পতন আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ছাত্রজনতার সম্মিলিত অবিনাশী প্রয়াস গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হলে সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনের প্রথম পর্যায় অহিংস ধারায় প্রবাহিত হলেও, পতিত সরকার ও দলের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিপুল সংখ্যক অত্যন্ত হৃদয়বিদারক প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। সম্ভবত সুচারুরূপে এগিয়ে যাওয়া আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে কতিপয় দুষ্কৃতকারী দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ জনগণ কখনোই সহিষ্ণুতার বিপরীতে সহিংস হওয়ার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা স্মরণযোগ্য নয়। চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় দ্রুততর সময়ের মধ্যেই দেশব্যাপী মোটামুটি শান্তির পরিবেশ ফিরে আসে।

সর্বস্তরের জনগণের অভাবনীয় সমর্থনে সফল অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশে ফিরেই শ্রদ্ধেয় ইউনূস স্যারের বক্তব্য ছিল, ‘আমি শুনলাম, এখানে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে, সম্পদ জ্বালিয়ে দিচ্ছে, চুরি করছে, অফিসআদালতে আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে। এগুলো হলো ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের কাজ হলো, সবাইকে রক্ষা করা। সবাই আমাদের ভাইবোন। তাদের রক্ষা করা এবং একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বিশৃঙ্খলা হলো অগ্রগতির শত্রু। তাদেরকে বুঝিয়ে হোক, আইনশৃঙ্খলার হাত দিয়ে হোক তাদের ফেরাতে হবে।’ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, ছাত্ররা আমাকে আহ্বান জানিয়েছে। আমি সাড়া দিয়েছি। দেশবাসীর প্রতি আমার আবেদন, আপনারা যদি আমার ওপর আস্থা রাখেন, ভরসা করেন তাহলে নিশ্চিত করেন যে, দেশে কোনো জায়গায় কারো ওপর হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব। আমার কথা যদি আপনারা না শোনেন তাহলে আমাকে আপনাদের কোনো প্রয়োজন নাই। আমাকে বিদায় দেন। আমি আমার কাজে ব্যস্ত থাকি। যদি আমাকে প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে আমাকে দেখাতে হবে যে, আমার কথা আপনারা শোনেন।’

সরকার গঠনের পরপরই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে সকল অরাজকতা কঠোর হস্তে দমন করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে বলেন, ‘অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যেই ছড়াবে বিজয়ী ছাত্রজনতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে। এ মুহূর্তে সরকারের প্রথম কর্তব্য হিসেবে আমরা এই ষড়যন্ত্রকারীদের কঠিন হাতে দমন করবো। স্বাধীনতার মুক্ত বাতাস যেন প্রত্যেকে বুক ভরে নিতে পারে এই নিশ্চয়তা দানই আমাদের সরকারের প্রথম প্রতিশ্রুতি। এই ব্যাপারে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করছি। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার এই মিলনমেলা থেকে বাদ যাবে না আমাদের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও। সেনানৌবিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা, কোস্টগার্ড কেউ বাদ যাবে না। অন্য সবার মতো তাদের প্রত্যেক সদস্য আজ ওপরওয়ালার আইনবহির্ভূত জবরদস্তিমূলক হুকুম থেকে মুক্ত। কারও জন্য এটা বিন্দুমাত্র ব্যাহত হলে আমাদের আজকের উৎসব ম্লান হয়ে যাবে।’

জনশ্রুতি মতে, দেশে ইতিমধ্যে অধিকাংশক্ষেত্রে স্বস্তিজনক পরিবেশ ফিরে আসলেও স্বার্থান্বেষী মহলসন্ত্রাসীদুষ্কৃতকারীরা ডাকাতিরাহাজানিলুটপাটে লিপ্ত রয়েছে। এতে জনগণের জানমালের ক্ষতি হচ্ছে না, প্রচন্ড আতঙ্কউৎকন্ঠা জনমনে গভীর বাসা বাঁধছে। বিভিন্ন উত্থাপিত অভিযোগে সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাজারমসজিদমন্দির ভাঙ্গা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানদোকানপাট ভাঙচুরলুটপাট এবং সরকারিবেসরকারি জমিবাড়িঘর দখলের অনাকাঙ্খিত ঘটনা উচ্চারিত হচ্ছে। এতে দেশবাসী যারপরনাই কাতরতায় নিপতিত। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারাদেশে এখনো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পরিপূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসাবাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভার সেবা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। পাসপোর্টসহ অধিকাংশ সরকারি সেবা এখনও পুরোপুরি সচল হয়নি। দূরপাল্লার বাস চলাচল করলেও ট্রেনের পরিপূর্ণ সেবা পর্যাপ্ত চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। প্রশাসনেও অস্বাভাবিকতা বিরাজমান। সরকারের পটপরিবর্তনে বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি নিয়েও দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। একপক্ষকে সরিয়ে আরেকপক্ষ দখলে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। পুরাতনদের বাদ দিয়ে পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অব্যাহত। চরম অস্থিরতা শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারিবেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে। একই চিত্র বিচারিক কার্যক্রমেও।

বিশ্লেষকদের মতে, চলমান অবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কারে সারাদেশে প্রয়োজনীয় সকল খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হতে হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভীতি রয়েছে তা দূর করা। দেশব্যাপী এখন যে হামলালুটতরাজ হচ্ছে দ্রুততর সময়ের মধ্যে সেগুলো বন্ধ করা। সকল সরকারি সেবাপ্রশাসনিকপুলিশি কার্যক্রম চালু, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, প্রশাসনসচিবালয়পুলিশ বিভাগের সংস্কার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া প্রশাসনে বিরাজিত অস্থিরতা দূর করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট জটিলতা সমাধানে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক আপামর নাগরিকের দেশ গড়ার কাজে অধিকতর মনোযোগী হওয়া একান্ত বাঞ্চনীয়।

আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচলতায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে নতুন করে যাতে আর কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়েও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো সরকারকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্বশীল সহযোগিতা করলেই কেবল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সর্বমহলের সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং আতঙ্কআশঙ্কা থেকে জনগণের মুক্তি। এটি অনস্বীকার্য যে, পরিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় দেশ প্রতিষ্ঠিত না হলে যেকোন মহল যেকোন ধরনের অশুভ সুযোগে তাদের কুৎসিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারী পৌরসভার নতুন প্রশাসক হলেন ইউএনও