চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এখন দেশসেরা। সাংগঠনিক দক্ষতা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নাগরিক সম্পৃক্ততাসহ ১৫ ক্যাটাগরিতে দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর পরিচালন ব্যবস্থা (সিটি গর্ভন্যান্স)’র উপর প্রতিবছর মূল্যায়ন করে থাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের (২০২৪–২০২৫) মূল্যায়নে দেশের ১২ সিটি কর্পোরশনের মধ্যে প্রথম হয়েছে চসিক। এর আগে গত অর্থবছরের (২০২৩–২০২৪) মূল্যায়নে সিলেট ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে চসিক দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। চলতি অর্থবছরের মূল্যায়নে সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, আঁরাই সেরা (আমরাই সেরা)। তারা জানান, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল দেশজুড়ে। আন্দোলন তীব্র হলে এর প্রভাব পড়ে দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর বিভিন্ন নাগরিক সেবা, উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে। পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের পর যা আরো বৃদ্ধি পায়। ব্যতিক্রম ছিল না চসিকও। তবে ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর গতি আসে চসিকের সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কাজে। বাড়তে থাকে নাগরিক সেবার পরিধিও। যার সামগ্রিক মূল্যায়নে দেশসেরা সিটি কর্পোরেশনের তালিকায় স্থান করে নেয় চট্টগ্রাম।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছর ২৩টি সূচকের উপর ভিত্তি করে সিটি গভর্ন্যান্স মূল্যায়ন করা হয়। চলতি অর্থবছর নির্ধারিত সূচক ছিল ১৫টি। গত ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি সূচকগুলোর উপর ভিত্তি করে সিটি গভর্ন্যান্স মূল্যায়ন করা হয়। গত সপ্তাহে এর ফলাফল প্রস্তুত করা হয়। যা গতকাল আনুষ্ঠকিভাবে চসিককে জানিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব ফিরোজ মাহমুদ স্বাক্ষরিত আনুষ্ঠানিক পত্রটিতে বলা হয়, ১ম বার্ষিক সিটি গভর্ন্যান্স মূল্যায়নে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে ২য় স্থান অর্জন করে, যা নিঃসন্দেহে গর্বের ও প্রশংসনীয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কঠোর পরিশ্রম ও আন্তরিকতার জন্য এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। ১৫টি সূচকের আলোকে পরিচালিত ২য় সিটি গভর্ন্যান্স মূল্যায়নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ১ম স্থান অর্জন করে, যা ধারাবাহিক উন্নয়নের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
চসিকের এ সাফল্য অর্জনে যারা নিরলস পরিশ্রম, দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছেন– তাদের অভিনন্দন জানিয়ে পত্রটিতে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলা হয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রতি বছরই সিটি গভর্ন্যান্স মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অক্ষুণ্ন রাখবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
কী বলছেন মেয়র :
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, সিটি গর্ভন্যান্স সূচকে এই প্রথম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সারা দেশে সেরা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য আনন্দের। নাগরিক প্রত্যাশা পূরণে আমাদের যে চেষ্টা তার মূল্যায়ন এটা।
সাফল্য অর্জনের পেছনের কারণ জানতে চাইলে মেয়র বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কর্পোরেশনকে ঢেলে সাজাতে কাজ করছি। ক্লিন ও হেলদি সিটি করার যে কার্যক্রম, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করেছি, অবৈধ স্থাপনা ভেঙে পার্ক উন্মুক্ত করেছি, দীঘিগুলো উন্মুক্ত করার যে পরিকল্পনা এবং জলাবদ্ধতামুক্ত চট্টগ্রাম শহর গড়ার পরিকল্পনা করে যে কাজ করছি; এই সূচকগুলোতে চট্টগ্রাম অন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোর তুলনায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই আমরা দেশসেরা পুরস্কার পেয়েছি।
পুরস্কার পাওয়ায় চসিকের প্রতি নগরবাসীর প্রত্যাশা বৃদ্ধি পাবে; এক্ষেত্রে সে প্রত্যাশা পূরণে চসিক কি করবে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, আমরা চেষ্টা করব আগামীতেও যেন আমরা সেরা অবস্থান ধরে রাখতে পারি। আমরা জলাবদ্ধতামুক্ত একটি পরিচ্ছন্ন শহর নগরবাসীকে উপহার দিতে চাই, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাব।
১০০–তে পেল ৯০ :
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিটি গর্ভন্যান্স মূল্যায়ন করা হয় ১০০ নম্বরে। এতে চসিক পেয়েছে ৯০। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ১৫টি সূচককে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মূল্যায়ন করা হয়। এর মধ্যে ৫টি সূচক নিয়ে ‘সাংগঠনিক কার্যক্রম’–এর নম্বর ৩০। এছাড়া ৬টি সূচক নিয়ে গঠিত ‘আর্থিক ব্যবস্থাপনা’ ৪০ নম্বর ও ৪টি সূচক নিয়ে গঠিত ‘নাগরিক সম্পৃক্ততা’ মূল্যায়ন করা হয় ৩০ নম্বরে। চসিক ‘সাংগঠনিক কার্যক্রম’–এ ২৩ নম্বর, ‘আর্থিক ব্যবস্থাপনা’য় ৩৭ নম্বর এবং ‘নাগরিক সম্পৃক্ততা’য় পেয়েছে ৩০ নম্বর।
তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন ৮৯ ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা সিলেট সিটি কর্পোরেশন পেয়েছে ৮৫ নম্বর। তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ১০ এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন পেয়েছে ৩০ নম্বর। এছাড়া অন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন ৫৩ নম্বর, ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন ৫৯ নম্বর, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন ৬৭ নম্বর, খুলনা সিটি কর্পোরেশন ৭৪ নম্বর, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ৭৬ নম্বর, রংপুর সিটি কর্পোরেশন ৮০ নম্বর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ৮১ নম্বর পেয়েছে।
চসিকের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন আজাদীকে বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের মধ্যে শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং ইফেক্টিভনেস বৃদ্ধি করায় সিটি গর্ভন্যান্স মূল্যায়নের মূল উদ্দেশ্য। ওরা অ্যানাইলাইসিস করে দেখেছে, যে সূচকগুলোতে কাজ ঠিকভাবে হলে সিটি কর্পোরেশনের সেবা জনগণের কাছে খুব ভালোভাবে পৌঁছাবে, ওই সূচকগুলোই ঠিক করেছে। যেমন –রাস্তা ও নালা–নর্দমা সংস্কার, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, ইপিআই টিকা দেয়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, কর আদায়, কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, ওয়ার্ড পর্যায়ে নিয়মিত সমন্বয় সভা আয়োজন করা, সেন্ট্রাল পর্যায়ে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সাথে মিটিং করা ইত্যাদি। অর্থাৎ যেসব কার্যক্রমগুলো নিলে একটা সিটি কর্পোরেশন ভালোভাবে কাজ করতে পারবে সেগুলো নিয়ে সূচক করা হয়। তিনি বলেন, প্রত্যেকটা সূচকে আবার সাব–সূচক থাকে। সবগুলো সূচকে কাজ করে আবার ডকুমেন্টস সাবমিট করতে হয়। এরপর মন্ত্রণালয় মূল্যায়ন করে।
চসিকের এ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পরদিন থেকেই প্রচণ্ড পরিশ্রম করছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওয়ার্ডগুলোতে গেছেন, সমস্যার সমাধান করেছেন। বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সাথে মিটিং করছেন। সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংস্থার সাথে সমন্বয় করে কাজগুলো এগিয়ে নিয়েছেন। এসব কারণেই এবার চট্টগ্রাম সেরা হয়েছে।