‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই কবি ইতিহাসের মহানায়ক। যিনি বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছেন মুক্তি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে স্বাধীনতার ডাক দেন।
৭ মার্চ লিখিত কোনো ভাষণ ছিল না। কিন্তু গোছানো, শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই ভাষণ জাতিকে অনুপ্রাণিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো এই ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রায় ১৮ মিনিটের এই ভাষণ ছিল স্বাধীনতারই ঘোষণা। অনেকে এই ভাষণকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করেন। লিংকনের সেই ভাষণ ছিল মাত্র তিন মিনিটের। তবে ভাষণটি ছিল পূর্ব–পরিকল্পিত ও লিখিত। ২৭২ শব্দের ভাষণটির মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে দেয়া হয়েছিল। অপরটি ১৯৬৩ সালের মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ অ্য ড্রিম’ ভাষণটির প্রথম অংশ লিখিত ও পঠিত, যা ১৬৬৬ শব্দের ১৭ মিনিটব্যাপী শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ।
এছাড়াও তৎকালীন আরো দুটো ভাষণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৪০ সালের উইনস্টাইন চার্চিলের ‘উই শ্যান ফাইট অন দ্য বিচেস’, এটি ৩৭৬৮ শব্দের ১২ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের, যা আইনসভার ৬০০ সদস্যের সামনে দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ‘অ্যা ট্রাইস্ট উইথ ডেসটিনি, ভাষণটি ৭৫৫ শব্দের পাঁচ মিনিট নয় সেকেন্ডের, সেটিও সংবিধান পরিষদের ৫শ মানুষের সামনে।
বিশ্বের গণমাধ্যমে ৭ মার্চের ভাষণ ফলাও করে প্রচারিত হয়। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার (৫ মার্চ) এবং টেলিগ্রাফ (৬ মার্চ) পত্রিকায় স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। নেলসেন ম্যান্ডেলা বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মূল দলিল। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশল। মার্শাল টিটো বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্থ হিথ বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে অন্যতম প্রেরণা হয়ে থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা। ঢাকাস্থ তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড লিখেছেন, ৭ মার্চ মুজিব যা বলেছিলেন, তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কি বলেননি। অনেকে আশা করেছিলেন তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালি মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি। নিউজ উইক পত্রিকার নিবন্ধ দ্য পয়েন্ট অব পলিটিঙ–এ বলা হয়েছে, ৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণের আলোকে। বিবিসি উল্লেখ করে পৃথিবীর ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্র নায়ক। রয়টার্স মন্তব্য করেছে, বিশ্বের ইতিহাসে এরকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সাথে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সাথে দেশ পরিচালনার দিক নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এএফপি বলেছে, ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালির যুদ্ধের দিক নির্দেশনাও দেন। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। টাইম ম্যাগাজিন, আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় প্রভাবশালী গণমাধ্যমে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ১৯৭১ সালে মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ–নিবন্ধ প্রকাশ করে।
৭ মার্চের ভাষণ বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দৃপ্তকন্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’ মহাকাব্যিক এই ভাষণ যুগ যুগ ধরে আমাদের প্রেরণা যোগাবে।