ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতু বদলের সাথে সাথে এর প্রকৃতির রূপ বদল হয়, বদল হয় ফসলের। এই বৈচিত্র্যই স্বাভাবিক ও সুন্দর। আবহমান কাল ধরে এ দেশের মানুষ ঋতুর সাথে তাদের চাষাবাদ, জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, উৎসব পালন করে আসছে। গ্রীষ্মে গরমে হাঁসফাস প্রকৃতি বর্ষার জলে স্নান করে শীতল হয়। শরতে নদীর পাড়ের কাশফুলেদের দেখতে দেখতে স্বচ্ছ আকাশে মেঘেরা ভেসে বেড়ায়। হেমন্তে ঘরে ঘরে নতুন ফসলের মৌ মৌ গন্ধ আর নতুন ধানে নবান্ন উৎসব। শীতকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় সতেজ শাকসবজি–পিঠাপুলি–খেজুর রস, বসন্তকালে ফুলে ফুলে রঙ্গীন প্রকৃতি আর কোকিলের কুহুতান। এদেশের মানুষ এ ঋতুচক্রের সাথে তাদের জীবন সাজিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এই স্বাভাবিকতা দিনে দিনে অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। বর্ষাকালে বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না, শীতে নেই কুয়াশা–খেজুররস, হেমন্তে নতুন ফসলের গন্ধের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে নবান্ন উৎসব। যন্ত্র, কৃত্রিম সার, কীটনাশক, হাইব্রিড বীজ ও কৃষি পদ্ধতি, প্রকৃতির দূষণ প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রকে বদলে দিয়েছে। অসীম চাহিদা, অপরিসীম লোভে প্রকৃতির সন্তানেরা ধরিত্রীকে খনন করে করে তার সব সুধা নিংড়ে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে চায়। প্রকৃতি উৎপাদনের জন্য যে প্রাকৃতিক কৌশল শিখিয়েছে তাকে বাতিল করে নিজের ইচ্ছেমতো প্রকৃতিকে বদল করছে। ফলে প্রকৃতি দিনে দিনে হারাচ্ছে তার উর্বরতা। সাময়িক লাভের বশবর্তী হয়ে দীর্ঘ মেয়াদে মাটির উৎপাদনশীলতা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের জন্যই প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিতে হবে। নতুবা আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
এই জরুরি বিষয়কে উপজীব্য করে সুমন টিংকুর রচিত নবান্ন ফিরে আস পাণ্ডুলিপিটি মোসলেম উদ্দিন সিকদারের নির্মাণে মঞ্চে এনেছে অ্যাভাঁগার্ড। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মঞ্চে নাটকটির ২৪ টি প্রদর্শনী মঞ্চস্থ হয়েছে।
চট্টগ্রামে যারা নিয়মিত নাটক রচনা করছেন তাদের মধ্যে সুমন টিংকু অন্যতম। তার রচিত নাটকের বিষয় বৈচিত্র্য বহুমুখী ও আকর্ষণীয়। নবান্ন ফিরে আস তেমন একটি অনালোকিত কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয়ে রচিত। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও মঞ্চে খুব বেশি দেখা যায়নি। বর্ণনাত্বক রীতিতে রচিত নাটকটি লোক নাটকের অভিজ্ঞ নির্দেশক মোসলেম উদ্দিন সিকদার বর্ণনা, অভিনয়, গীত, কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে নির্মাণ করেছেন। মঞ্চ, আলোক ও পোশাকের পরিকল্পনাও করছেন তিনি। মঞ্চ পরিকল্পনায় কয়েকটি প্লাটফর্ম ও পর্দার যথাযথ ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো বাহুল্য করা হয়নি।
দৃশ্যভেদে পটচিত্র ও মুখোশ সুপ্রযুক্ত হয়েছে। তবে কোরিওগ্রাফিতে গামছা ও কাপড়ের ব্যবহার গতানুগতিক মনে হয়েছে। সুপরিকল্পিত আলোছায়ায় দৃশ্যগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে। লাইটের সাথে টর্চ ও হারিকেনের ব্যবহার আলোক পরিকল্পনাকে ঋদ্ধ করেছে। বহিরাগতদের প্রলোভনের অশুভ পরিণতির ইঙ্গিত ও জমিতে কীটনাশকের বিষাক্ত ছোবলের দৃশ্যে মুখোশ এবং টর্চের ব্যবহার দৃশ্যগুলোকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। তবে একাধিক দৃশ্যে মাঝের প্লাটফর্মে অভিনেতাদের হাত তুলে সংলাপ প্রক্ষেপণে পেছনে আলোছায়া কিছুটা পৌনঃপুনিক মনে হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের মঞ্চে আবহ পরিকল্পনা ও সুরারোপে মঈনুদ্দীন কোহেল একটি অপরিহার্য নাম। এ নাটকেও তিনি দেশীয় অনুষঙ্গের ব্যবহারে সংযমী আবহ পরিকল্পনা করেছেন ও গানের সুরারোপ করেছেন। গানের সাথে কোরিওগ্রাফি পরিকল্পনা করেছেন হেমা বড়ুয়া। নাটকের দৃষ্টি নন্দন পোস্টার ডিজাইন করেছেন বিশ্বজিত তলাপাত্র।
নবান্ন ফিরে আস নাটকে অ্যাভাঁগার্ডের কয়েকজন অভিজ্ঞ অভিনেতার সাথে একদল তরুন অভিনেতা অভিনয় করেছেন। প্রযোজনায় একক প্রাধান্য অভিনয়ের তেমন সুযোগ না থাকলেও রহিমা খাতুন লুনা তার বলিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য আলাদাভাবে মনোযোগ কাড়েন। তরুন সদস্যরা সামষ্টিকভাবে অভিনয়ের দ্বারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকটিকে টানটানভাবে টেনে নিয়ে গেছেন। পুরো নাটকে দেশীয় উপকরণ ব্যবহৃত হলেও মোবাইলের ব্যবহার না করলে তা যুক্তিযুক্ত হতো বলে মনে হয়। নাটকটির বিষয়বস্তুর বিচারে নামকরণ ‘নবান্ন ফিরে আস’ যথার্থ হলেও আস শব্দটি অনভ্যাসের কারণে কিছুটা বেখাপ্পা মনে হয়।
বিষয় বৈচিত্র্য, বলিষ্ঠ নির্মাণ, সামষ্টিক অভিনয়, সার্বিক পরিকল্পনা মিলে ‘নবান্ন ফিরে আস’ একটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। এ নাটকটি শহুরে মঞ্চের পাশাপাশি কৃষিপ্রধান অঞ্চলে প্রদর্শনের উদ্যোগ নিলে চাষাবাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিগত পঁচিশ বছরে প্রযোজনা, কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার দ্বারা অ্যাভাঁগার্ড বর্তমানে চট্টগ্রামে সক্রিয় থিয়েটার দলের মধ্যে তাদের সুশক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। দলটি তাদের কমিটমেন্ট অনুযায়ী থিয়েটারে পেশাদারিত্ব তৈরি ও কার্যক্রমের দ্বারা গ্রুপ থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করবে এ প্রত্যাশা করাই যায়। অ্যাভাঁগার্ড’র রজত জযন্তীর জন্য অগ্রিম শুভেচ্ছা।