অ্যান্টিম্যাটার শব্দটি দুইটি অংশে বিভক্ত: “অ্যান্টি” অর্থ “বিপরীত” এবং “ম্যাটার” অর্থ “পদার্থ”। অর্থাৎ, এটি এমন এক পদার্থ যার প্রতিটি মৌলিক কণা একটি বিপরীত ধর্ম ধারণ করে। একটি সাধারণ পদার্থের গঠনে থাকে ইলেকট্রন (ঋণাত্মক চার্জ), প্রোটন (ধনাত্মক চার্জ) এবং নিউট্রন (নিরপেক্ষ)। অ্যান্টিম্যাটারের ক্ষেত্রে, ইলেকট্রনের বিপরীতে থাকে পজিট্রন (ধনাত্মক চার্জ), প্রোটনের বিপরীতে অ্যান্টিপ্রোটন (ঋণাত্মক চার্জ), এবং নিউট্রনের বিপরীতে অ্যান্টিনিউট্রন। এই অ্যান্টিকণাগুলির ধর্মগুণ সাধারণ কণাগুলোর বিপরীত হলেও ভর ও অন্যান্য গাঠনিক বৈশিষ্ট্যে প্রায় একরকম।
১৯২৮ সালে পল ডিরাক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিকতাবাদের সূত্র ধরে প্রথম অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্বের ধারণা দেন। গণিততত্ত্ব ব্যবহার করে তিনি এমন একটি সমীকরণ প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায়্তপ্রতিটি কণার একটি বিপরীতধর্মী কণা থাকা সম্ভব। ১৯৩২ সালে কার্ল ডেভিড অ্যান্ডারসন মহাকাশ থেকে আগত কসমিক রশ্মির মাধ্যমে পজিট্রনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন এবং তার মাধ্যমে ডিরাকের তত্ত্ব বাস্তবে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে অ্যান্টিপ্রোটন, এবং আরও পরে অ্যান্টিনিউট্রনের অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয়। অ্যান্টিম্যাটার আজ কল্পনা নয়, বরং পরীক্ষাগারে তৈরি ও পর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতা।
তবে প্রশ্ন হলো, যদি বিগ ব্যাং-এর সময় সমান পরিমাণ ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে আজ আমরা কেবল ম্যাটার দিয়েই কেন ঘেরা? মহাবিশ্বের তারাগুলোর আলো, গ্যালাক্সি, গ্রহপুঞ্জ এমনকি আমাদের শরীর্তসবই ম্যাটার দিয়ে তৈরি। কিন্তু অ্যান্টিম্যাটার প্রায় অদৃশ্য। এই অসামঞ্জস্য বা “Baryon Asymmetry ” হলো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল রহস্যগুলোর একটি। গবেষকরা মনে করেন, বিগ ব্যাং-এর পর অজানা কোনো কণা বা ঘটনা এই ভারসাম্য ভেঙে দিয়েছে এবং সামান্য পরিমাণ ম্যাটার বেঁচে গিয়ে মহাবিশ্বের গঠন ঘটিয়েছে।
অ্যান্টিম্যাটার ও ম্যাটার একসাথে এলে “অ্যানাইহিলেশন” ঘটে, যার ফলে তৈরি হয় বিশাল শক্তি এবং গামা রশ্মি। এই বিপুল শক্তি উৎপাদনের সম্ভাবনা অ্যান্টিম্যাটারকে ভবিষ্যতের শক্তি উৎস হিসেবে তুলে ধরেছে। মাত্র ১ গ্রাম অ্যান্টিম্যাটার সম্পূর্ণ অ্যানাইহিলেট হলে উৎপন্ন শক্তি হয় প্রায় ৯০ ট্রিলিয়ন যা একটি শহরকে কয়েক সপ্তাহ বিদ্যুৎ দিতে পারে। ফলে বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিম্যাটার-ভিত্তিক জ্বালানি বা মহাকাশযান চালানোর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। যদিও এটি এখনো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ, ভবিষ্যতে এটি হতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী ও পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎস।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যান্টিম্যাটারের ব্যবহার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। PET স্ক্যান ( Positron Emission Tomography ) নামক প্রযুক্তিতে পজিট্রন ব্যবহার করে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোষগত চিত্রায়ন সম্ভব হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশেষ করে ক্যানসার সনাক্তে চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে। এছাড়াও CERN I Fermilab -এর মতো গবেষণাগারগুলোতে নিয়মিত অ্যান্টিপার্টিকল তৈরি ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, এবং অনেক অজানা পদার্থ ও শক্তির রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।
বাংলায় বলা যায়, অ্যান্টিম্যাটার আমাদের “প্রতিচ্ছবি মহাবিশ্ব”-এর একটি ইঙ্গিত। যদি আমাদের দৃশ্যমান পৃথিবীকে বলা হয় আলোর পৃথিবী, তবে অ্যান্টিম্যাটার হলো তার অন্ধকার ছায়া। এটি এমন এক বাস্তবতা, যা অদৃশ্য হলেও অস্তিত্ব রাখে। একে যদি আমরা পুরোপুরি বুঝতে ও ব্যবহার করতে পারি, তবে শুধু শক্তির ক্ষেত্রেই নয়, পদার্থবিদ্যার মৌলিক আইন, মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য এবং মহাকাশ অভিযানে এক বিপ্লব ঘটতে পারে।
অ্যান্টিম্যাটার আমাদের শেখায়্তপ্রতিটি কিছুর বিপরীত কিছু থাকে। যেমন আলো ও অন্ধকার, দিন ও রাত, সুখ ও দুঃখ, তেমনি আছে পদার্থ ও তার বিপরীত রূপ। অ্যান্টিম্যাটার তাই কেবল বিজ্ঞান নয়, এক ধরনের দার্শনিক উপলব্ধিও্তযা আমাদের শেখায়, বিপরীত থাকা মানেই বিরোধিতা নয়, বরং তা-ই ভারসাম্য তৈরি করে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, অ্যান্টিম্যাটার হলো মহাবিশ্বের অজানা, অথচ সম্ভাবনাময় এক অধ্যায়। এর রহস্যভেদ করতে পারলেই আমরা নতুনভাবে বুঝতে পারবো আমাদের চারপাশ, আমাদের অস্তিত্ব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ। এটি একদিকে শক্তি, অন্যদিকে কৌতূহল, আবার তৃতীয় দিক থেকে দেখল্তেএটি মহাবিশ্বের নিঃশব্দ আর প্রতিফলিত ছায়া।