অ্যানেস্থেসিয়াকে ভয় পাবেন না

ডা. দুলাল দাশ | সোমবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

অ্যানেস্থেসিয়া’ শব্দটা শুনলে অনেকেই প্রথমে ভয় পায়, আবার অনেকেই বলে বেহুঁশ করা যেটা অপারেশনের সময় করা হয়। কিন্তু শৈল্য চিকিৎসায় এটা অপরিহার্য। নতুবা ঠিকমত অপারেশান করা যাবে না, কারণ ব্যথা পেলে কি অপারেশন করা যায়? কখনো না, এটা ব্যথানাশক একটা পদ্ধতি। প্রতি বৎসর ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী অ্যানেস্থেসিয়া দিবসটি পালিত হয়। আমাদের বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। অ্যানেস্থেসিয়া প্রাপ্ত রোগী ছাড়া এই বিষয়ে কারো ধারনা থাকে না। এটি একমাত্র প্রযোজ্য রোগীর অপারেশনকালীন সময়ে। বর্তমান মেডিকেল সাইন্সের অন্যান্য বিষয়ের মত এই বিষয়টির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। যার ফলে অ্যানেস্থেসিয়া রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন কমেছে, অপারেশন অনেক সহজ হয়েছে। অপারেশনের সময় ইহার গুরুত্ব খুবই বেশি। ইহা খুবই স্পর্শকাতর একটি সাবজেক্ট। একজন অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ একটু অমনোযাগী হলে রোগী সংকটে পড়তে পাড়ে, অ্যানেস্থেসিয়ার অর্থ হলো চেতনানাশক। রোগীকে অজ্ঞান অবস্থায় নেওয়া ও অসারতা, যার মাধ্যমে একজন সার্জন সুচারুভাবে অপারেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এর সুচনা লগ্নে আমরা দেখতে পাই ২০০০ বি.সিতে যখন হার্বস এবং ওয়াইন এর ব্যবহারে প্লাস্টিক সার্জারী করা হতো। এগুলি এখন অবিশ্বাস্য। তখনকার দিনের আরও অনেক নির্মম উদাহরণ আছে। প্রকৃত অ্যানেস্থেসিয়ার সূচনা ১৮৪৬ সালে। ১৯২০ সালে শুরু হয় ক্লোরফর্ম ও ইথারের ব্যবহার। আরও ইতিহাস আছে যখন অপারেশনের সময় মাংসকে শিথিল করার জন্য যে ঔষুধ ব্যবহার হয় এটি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান এলাকায় বন মানুষেরা পশু পাখি শিকারে ব্যবহার করতো। আজ অ্যানেস্থেসিয়ার পদ্ধতিগত উন্নতি ও নতুন নতুন অ্যানেস্থেটিক ঔষুধ আবিষ্কারের ফলে দীর্ঘ সময় ধরে অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে সিংঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অপারেশন সম্ভব হয়েছে এবং রোগী সুস্থ রয়েছে। অপারেশন শেষ হওয়ার সাথে সাথে রোগী প্রশ্নের জবাব দেয়, চোখ খোলে এবং জিহবা দেখায়। বর্তমান জেলা শহরে, প্রাইভেট ক্লিনিক গুলোতে উন্নতমানের মনিটরিং সিস্টেম, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়। তাই এখন ৯৯% রোগী ঝুঁকি মুক্ত থাকে। এই কথাগুলি বলা হলো এই কারণে যে, রোগীরা অপারেশনের থেকে অ্যানেস্থেসিয়াকে বেশি ভয় পায়।

আমাদের দেশে সার্জনরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপারেশন করে জটিল জটিল রোগ সারাচ্ছে। যেমনহার্টের অপারেশন, মস্তিষ্কের জটিল অপারেশন ব্রেইন টিউমার, স্পাইন্যাল সার্জারী, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন আরও অনেক। অ্যানেস্থেসিয়ার পদ্ধতিগত ভাগযেমন () জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া (পুরো অজ্ঞান করে শরীর অবশ করা) () লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া-(শুধু আপারেশনের জায়গা), () রিজিওন্যাল অ্যানেস্থেসিয়া (একটা এরিয়াকে অবশ করা) () স্পাইন্যাল, এপিডুরেল অ্যানেস্থেসিয়া () ফুল রেঞ্জ নার্ভ ব্লক () ব্লক সিস্টেম প্রভৃতি। এখানে স্পাইনাল অ্যানেস্থেসিয়া খুবই জনপ্রিয়। কারণ এটা নাভির নিচে থেকে পা পর্যন্ত অবশ করে দেওয়া হয়। লোয়ার এভডোমিনাল অপারেশন এটাতে হয়। যেমন সিজারিয়ান, জরায়ু ফেলে দেওয়া, টিউমার, অ্যাপেনডিক্স, মুত্রথলের পাথর প্রভৃতি। সিজারিয়ান সেকশনে বাচ্চা বাহির হওয়ার সাথে সাথে মা বাচ্চার কান্না শুনতে পায়, নার্সরা বাচ্চাকে তখনই মায়ের চুমু খাওয়ায়। জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়াকে অনেকে ভয় পায়, কারণ তারা মনে করে অজ্ঞান হওয়ার পর পুনরায় জ্ঞান ফিরে আসবে কিনা? তবে আশ্বস্ত করা যায় যদি কোন ক্রটি না থাকে। তবে ১০০% জ্ঞান ফিরে পায়, এই জন্য যে কোন অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার আগে রোগীকে একটা ধারনা দিতে হয়, তাকে আশ্বস্ত করতে হয় এবং তার সব পরীক্ষা নিরিক্ষা ভালভাবে পর্যালোচনা করা হয়। এটাকে অ্যানেস্থেটিক ফিটনেস বলা হয়। যদি আগে থেকে কোনো রোগ থাকে যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও থাইরয়েড প্রভৃতি তবে ঐ গুলির চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে ফিট করতে হয়। বর্তমান অ্যানেস্থেসিয়ার সাথে যোগ হয়েছে আই, সি, ইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)

অপারেশনের সময় বা অপারেশনের পরে কোনো রোগী খারাপ হয়ে গেলে সাথে সাথে আই, সি, ইউতে নিয়ে গিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়। এইগুলোর পুরো প্রক্রিয়ায় থাকে একজন অভিজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। এখন পেট না কেটে অনেক রকমের অপারেশন করা হয়। যেমন পিত্তের পাথর, প্রোস্টেট, কিডনির পাথর, জরায়ুর, অ্যাপেনডিস্ক প্রভৃতি। সবগুলোতে জেনারেল বা স্পাইন্যাল অ্যানেস্থেসিয়া লাগে। মাঝে মাঝে মিডিয়াতে দুএকটা দুর্ঘটনার কথা শুনা যায়। এই গুলি মফস্বল এরিয়াতে ঘটে। হয়ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অসাবধানতার কারণে ঘটতে পারে। পালস অঙিমেট্রি এবং তার সাথে ব্লাডপ্রেশার মনিটর যন্ত্রপ্রাতি সেকেন্ডে রোগীর অঙিজেন সেচুরেশন ও রক্তচাপ পুরো অপারেশনে রেকর্ড করা হয়। সুতরাং বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সুতরাং অ্যানেস্থেসিয়াকে ভয় পাবেন না।

লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসোরেন কিয়ের্কেগার্ড : অস্তিত্ববাদের জনক
পরবর্তী নিবন্ধএমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যাতে ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়