মরহুম এডভোকেট আলহাজ্ব এ. এম. য়্যাহয়্যা দেওয়ানী, কোম্পানি ও ব্যাংকিং আইনের ওপর একজন বিশেষজ্ঞ–আইনবিদ হিসেবেই তাঁর প্রধান পরিচয়। কিন্তু এই প্রসিদ্ধির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তাঁর আরো বহুতর পরিচয়। তিনি ছিলেন মানব কল্যাণে নিবেদিত এক কর্মযোগী পুরুষ। আইন ছিলো তাঁর পেশা, মানবপ্রেম ছিল তাঁর নেশা। কর্মক্ষেত্র ছিলো চট্টগ্রাম আদালত ভবন, সেজন্যে শহরে না থেকে উপায় ছিলো না। কিন্তু নাড়ির টানে মনটা পড়ে থাকতো হাটহাজারী থানার হালদা তীরের বৃহত্তর অবিভক্ত গুমানমর্দন গ্রামে। একদিন জীবনের বৃহত্তর সাধনক্ষেত্রে মহত্তর কর্মের ডাক পড়বে যাঁর, তাঁকে তো আদালত ভবনের সংকীর্ণ পরিসরে পড়ে থাকলে চলে না। কখনো সমবায়ী, কখনো গ্রাম উন্নয়ন, কখনো জনপ্রতিনিধি বা ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান, কখনো মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি, কখনো শিক্ষাব্রতী ইত্যাদি নানা রূপে নানা ক্ষেত্রে সমাজ ও মানুষের হিতকর কর্মের প্রবর্তনায় এক কল্যাণময় পুরুষের অবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে বৃহত্তর অবিভক্ত গুমানমর্দন তথা সমগ্র চট্টগ্রাম।
জন্ম তাঁর ১৯৩৪ সালের ২৭ অক্টোবর। পিতা মরহুম এম. আমিন উল্ল্যাহ্ ছিলেন বার্মার (মায়ানমার) ‘বার্মা অয়েল কো.’-এর রেঙ্গুন মান্দালয়–মৌলমেন এজেন্ট ফার্মের এটর্নি। আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্যয়্যার প্রাথমিক শিক্ষা শুর হয় গুমানমর্দ্দন পেস্কারহাট প্রাইমারি স্কুলে। এরপর ভর্তি হন নাঙ্গলমোড়া এম ই স্কুলে। এ স্কুলে তাঁকে নিয়েই নবম শ্রেণি খোলা হয়। পরের বছর ভর্তি হন ফটিকছড়ির রোসাংগিরি হাইস্কুলে। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৫৬– তে বি.এ পাস করে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা বার সমিতিতে যোগ দেন। দীর্ঘ ৪১ বছরের পেশাগত জীবনে নানা দায়িত্ব ও পদ অলংকৃত করেছেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য, জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরি পরিষদ সদস্য, ১৯৮২–৮৫ সময়কালে সহযোগী ও ভারপ্রাপ্ত সরকারি কৌশুলি (জিপি) সহ বহুবিধ দায়িত্ব দক্ষতা ও সততার সাথে পালন করেছেন। তাঁর সিনিয়র প্রখ্যাত আইনজীবী এ এইচ এম মোজাফ্ফর আহমদ খান। মরহুম এডভোকেট য়্যাহয়্যার বহু অ্যাসোসিয়েটের মধ্যে হাটহাজারীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন, কক্সবাজার জেলা বারের সিনিয়র এডভোকেট মোহাম্মদ রাশেদ, চট্টগ্রাম জেলা বারের এডভোকেট আবুল মাসুম, মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মোহাম্মদ মুছা, মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মোহাম্মদ আলী, এডভোকেট আবদুল হামিদ, এডভোকেট নুরল আনোয়ার, এডভোকেট সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, এডভোকেট মোহাম্মদ শরীফউদ্দিন, নিজ পুত্র এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান, কন্যা এডভোকেট জান্নাতুন নাঈম রুমানা সহ অনেকেই পেশায় যশ ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর খণ্ডকালীন অ্যাসোসিয়েটদের কেউ বিচারপতি, জজ, মন্ত্রী হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত আছেন ও ছিলেন।
সমবায় আন্দোলনে নানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এডভোকেট য়্যাহ্যয়্যা বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের জয়েন্ট সেক্রেটারি, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের পরিচালক, পরিচালক–বাংলাদেশ কো–অপারেটিভ জুট মিলস, চট্টগ্রাম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল, চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল কো–অপারেটিভ ব্যাংকের সভাপতি, হাটহাজারী থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সভাপতিসহ জেলা ও থানা পর্যায়ে বহু শিক্ষা, সামাজিক ও সমবায়ী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পিছিয়ে পড়া গ্রাম অবহেলার চরম শিকার বৃহত্তর গুমানমর্দনের স্বার্থে এ এম য়্যাহ্যয়্যা এক সময় হাটহাজারির বৃহত্তর অবিভক্ত গুমানমর্দন গ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬৪–৭১ তাঁর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি এলাকার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন। তাঁর সময়ে প্রায় সকল সড়ক নির্মাণ ও সেতু পাকা করা হয়, প্রায় একশত টিউবওয়েল বসে। প্রতিষ্ঠা পায় স্কুল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সেকালের গুমানমর্দন ইউনিয়ন (বর্তমানে গুমানমর্দন, নাঙ্গলমোড়া ও ছিপাতলী ইউনিয়ন)- এর উন্নয়ন ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ এডভোকেট য়্যাহয়্যা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছেন। তাছাড়া জেলা পরিষদে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
এডভোকেট য়্যাহয়্যার জীবনে ভাষা আন্দোলন এক গুরত্বপূর্ণ ঘটনা। মাতৃভাষার দাবিতে হরতাল ও বিক্ষোভ চলাকালে পিকেটিংরত অবস্থায় নিউমার্কেট মোড়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীরা তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়। একই অনুষঙ্গে পূর্ব বাংলার দাবির সমর্থনে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সামাজিক ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনে একাত্ন হয়েছিলেন। তারুণ্যের বিস্তৃত একটি অধ্যায় তাঁর কেটেছে বামপন্থি আন্দোলনে। জেলা ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। জাঁদরেল রাজনীতিক ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিপক্ষে (১৯৭০এর নির্বাচনে) অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মনোনয়নপত্রে সমর্থক হন প্রবল ঝুঁকি নিয়ে। মনোনয়ন বাছাইয়ের আগে তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়।
তাঁর সাথে আরো ছিলেন সাংবাদিক সাধন কুমার ধর ও আরিফ বিল্লাহ। শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে প্রবল আগ্রহের ফলে এডভোকেট য়্যাহয়্যা বহু প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, পালন করেছেন–সহ প্রতিষ্ঠাতা/উদ্যোক্তার গুরুদায়িত্ব। দীর্ঘদিন গুমানমর্দন পেস্কারহাট হাইস্কুল, পূর্ব গুমানমর্দন সরকারি প্রাইমারি স্কুল, নাঙ্গলমোড়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মাদ্রাসা ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে অবদান রাখেন। সভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিষ্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রী পরিষদ ও ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য ছিলেন। সেনা কল্যাণ সংস্থা, তদানিন্তন অস্ট্রেলেসিয়া ব্যাংক, মহালক্ষ্মী ব্যাংক, হাবীব ব্যাংক, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ইউসিবিএল, বেসিক ব্যাংক, বিএটিবি, সিডিএ সহ বহু দেশি বিদেশি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের আইন উপদেষ্টা ছিলেন।
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের প্রায় ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান পাকিস্তান–পন্থী মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামে একজন এডভোকেট আলহাজ্ব বদিউল আলম ও উত্তর চট্টগ্রামে একজন এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। আওয়ামী নেতৃবৃন্দের পরামর্শে তিনি ১৯৭১ সালের ঘোর দুঃসময়ে সৎ সাহস, বুদ্ধিমত্তা, কঠোর শ্রম আর কুশলী নেতৃত্বে নিজের ইউনিয়ন ও সন্নিহিত এলাকাকে হানাদার রাজাকারমুক্ত রাখতে সক্ষম হন।
গুমানমর্দন ইউনিয়ন ছিল মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘুসহ সব মানুষের অভয়াশ্রম। তাঁর ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধাদের আহার, রাত্রিযাপন, নিরুপদ্রব হয়। বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে সম্ভবত বাংলাদেশে এটিই একক উদাহরণ–তাঁর এলাকার একজন সংখ্যালঘুকেও দেশ ত্যাগ করতে হয়নি। নয় মাস গ্রামটি স্বাধীন এবং হানাদার ও রাজাকারমুক্ত ছিল। প্রশাসন ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাক বাহিনীর অভিযানের অগ্রিম সংবাদ সংগ্রহ করে পূর্বাহ্নে তিনি মুক্তিসেনাদের জানিয়ে দিতেন, বিভিন্ন পন্থায় সেনা অভিযান বাধাগ্রস্ত করেছেন। এসব কারণ ও রাজাকার নিয়োগে বিরোধিতার ফলে খান সেনারা থাকে হত্যা করার জন্য ধরে নিয়ে যায়। তাঁর বাড়িতে চট্টগ্রামের বহু মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে হানাদারদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আস্তানায় অপারেশন পরিচালনা করে আবার ফিরে আসতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে এসব কথা উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য এডভোকেট য়্যাহয়্যাকে গণসংবর্ধনা দেয়া হয় ও তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে ২টি স্বর্ণপদক এবং নগদ অর্থে পুরস্কৃত হন।
প্রচলিত আইন ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মৌলিক চিন্তার অধিকারি আলহাজ্ব এ.এম য়্যাহয়্যা সমবায় বিষয়ক বেশ ক‘টি সুচিন্তিত প্রবন্ধ–নিবন্ধনের লেখক। এককালে তাঁর লেখা জাতীয় ও স্থানীয় পত্র–পত্রিকায় নিয়মিত দেখা যেতো। তাঁর সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিমাত্রই জনাব য়্যাহয়্যার গভীর জ্ঞান, অনুসন্ধিৎসু মন ও চারিত্রিক সততা সম্পর্কে অবহিত। ইসলামের জীবনবোধে নিবেদিত এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তির রচিত একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘কুরআন ও হাদীসের দোয়া’ শিরোনামে। মহীয়সী নারী আলহাজ্ব জায়তুন আরা বেগমের সাথে ১৯৬১ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের একমাত্র পুত্র এডভোকেট এ,এম জিয়া হাবীব আহসান একজন কলামিস্ট, খ্যাতিমান মানবাধিকার সংগঠক, সমাজসেবী ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা; পিতার মতো আইন পেশায় নিয়োজিত, দক্ষ আইনবিদ হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। মরহুমের ৬ কন্যার একজন জান্নাতুল নাঈম রুমানাও এডভোকেট। দুই কন্যা জান্নাতুল ফেরদৌস ও জান্নাতুল মাওয়া চিকিৎসক। বড় মেয়ে কানিজ ফাতিমা ও মেঝো মেয়ে তাসনীম আরা বেগমও উচ্চ শিক্ষিতা মাস্টার্স পাস।
নিজের আরদ্ধ কাজ সম্পাদন এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে সম্প্রসারণের লক্ষে আলহাজ্ব য়্যাহ্য়্যা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ‘জায়তুন–য়্যাহয়্যা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ফান্ড গঠনের সময় বিপুল অর্থ দান করেছেন। এই ট্রাস্ট ইতোমধ্যে দারিদ্র বিমোচন ও সমাজ উন্নয়নে বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক কার্যকর সেবাধর্মী প্রকল্প গ্রহণ ও পরিচালনা করে আসছে। তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষের হক্ব তথা হক্কুল ইবাদ আদায় করে একাধারে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং দারিদ্র বিমোচন সম্ভব। লেখক:- মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক।