অহনার আকাশ ছোঁয়া

১০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা জয়

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

মাত্র ১০ বছর বয়সে বিশ্বের দশম পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্প ঘুরে এসেছে চট্টগ্রামের সানশাইন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া অহনা রিদা জাহরা। সম্প্রতি বাবা অনিকেত চৌধুরীর সঙ্গে হিমালয়ের অন্নপূর্ণা অঞ্চলে ট্রেকিং করে ১৩ হাজার ৫৫০ ফুট (৪ হাজার ১৩০ মিটার) উচ্চতায় পৌঁছায় সে। এ যেন তার আকাশ ছোঁয়া।

দুই পাশে পর্বত, পেছনে সাদা শুভ্রতা, মাথার উপর নীল আকাশ নিয়ে বাবামেয়ে একসাথে তুলে ধরেছেন লালসবুজের পতাকা। অক্টোবরের ৩০ তারিখ শুরু হওয়া এই রোমাঞ্চকর যাত্রা দেশে ফেরার মাধ্যমে শেষ হয় চলতি মাসের ৯ তারিখ। ১১ দিনের সেই অনুভূতি জানতে অহনা ও তার বাবা স্থপতি অনিকেত চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় আজাদীর। কথা বলতে বলতে কিছু সময়ের জন্য যেন তারা ফিরে গেলেন নেপালের অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের আরোহণের সেই দিনগুলোতে।

দিনটি ছিল মঙ্গলবার। অজানাকে জানতে বিশ্বের দশম পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা পর্বত আরোহণে বাবার সঙ্গে তার যাত্রা ঢাকা থেকে। ভ্রমণটির ব্যবস্থাপনায় ছিল পর্বত আরোহণ বিষয়ক সংগঠন রোপফোর। বাবামেয়ে ছাড়াও দলে ছিল আরো ৯ জন। তবে অল্প বয়স হওয়ায় প্রথম থেকে সবার মধ্যমণি অহনা। ছোট্ট এই মেয়েটির পর্বতারোহণ নিয়ে প্রথম দিকে সকলের মনে কিছুটা সংশয় ছিল। তবে তার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রস্তুতি শুনে সকলে আশ্বস্ত হন। তাকে ঘিরে সবার মাঝে কাজ করছিল উদ্দীপনা। ট্রেকিং সম্পর্কে অহনা প্রথম জানতে পারে বাবার কাছে। এরপর রোপফোরে যোগাযোগ করে বাবামেয়ে। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতায় তারা শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অংশ নেন একটি মৌলিক প্রশিক্ষণে। যেখানে ছিল সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় এবং চট্টগ্রামের ফয়’স লেকে অবস্ট্রাকল কোর্স এবং ট্রিটপ অ্যাক্টিভিটি সম্পন্ন করার মতো চ্যালেঞ্জ। এরপর প্রশিক্ষক জানান, অহনা যেতে পারবে পর্বত আরোহণে। সে অনুযায়ী শুরু হয় যাত্রা। নেপাল পৌঁছে পোখরা হয়ে পরদিন ঝিনু থেকে শুরু হয় মূল ট্র্যাকিং।

অনিকেত চৌধুরী বলেন, ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে অহনার মাঝে কোনো উদ্বেগ ছিল না। তার মাঝে কাজ করছিল পর্বতারোহণের রোমাঞ্চ। মূল ট্র্যাকিং শুরু হওয়ার পর সবার আগে পথ চলছিল সে। যা টিমের অন্যদের উৎসাহিত করছিল। অহনার পুরো ভ্রমণ ছিল রোমাঞ্চে ভরপুর। পাশে থাকা পিতার উপস্থিতি তার ভ্রমণকে করেছে আরো প্রাণবন্ত। নিশ্চিন্তে ছুটে চলা শুধু অজানাকে জানতে। পর্বতের বিভিন্ন উচ্চতায় নানা দেশের নাগরিকদের দেখা এবং তাদের সাথে সৌজন্য বিনিময়, তীব্র শীতে গায়ে একাধিক গরম কাপড়, সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াসবই যেন তার কাছে স্বপ্নের মতো। গল্পের ছলে বলতে বলতে হারিয়ে যাচ্ছিল সে।

অহনা বলল, ক্যালেন্ডারের পাতায় ৩ নভেম্বর। পৌঁছে যাই অন্নপূর্ণার বেজ ক্যাম্পে। মাঝে পাড়ি দিই ডোবান, মচ্ছপুছার, ল হিমালয়া গ্রাম, দেউরালিসহ নানা জায়গা। প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে ছিল উপভোগ্য। অপরূপ অন্নপূর্ণা পর্বতশৃঙ্গের বেজ ক্যাম্পে ওঠার সময় তাপমাত্রা ছিল অনেক কম। এত ঠাণ্ডা কখনো অনুভব করিনি। গায়ে শীতের ভারী পোশাক, সাথে ভারী ব্যাগ। এসব নিয়েই হেঁটেছি। পথ কখনো ছিল পাথরের, কখনো হিমশীতল বরফের। এর মাঝেই চলতে হয়েছে। ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছিল।

অনিকেত চৌধুরীর উচ্ছ্বাস ছিল অন্যরকম। তার ভাষায়, মেয়ের ইচ্ছাপূরণ করতে পারার আনন্দে আনন্দিত আমি। মেয়েকে নিয়ে ১১ দিনের ট্যুরে যে সময় কাটিয়েছি সেটা নিঃসন্দেহে বাবা হিসেবে জীবনের সেরা সময়। সার্বক্ষণিক মেয়েকে দেখভাল করা, খাওয়ানো, ঘুম থেকে যথাসময়ে তোলা, হাঁটার জন্য পোশাক পরিয়ে প্রস্তুত করাসবই ছিল আমার কাছে উপভোগ্য।

৪ নভেম্বর ফিরতি পথ ধরে অহনা এবং তার দল। বিভিন্ন পথ ঘুরে একদিন পর পৌঁছে পোখরায়। তারপর ৯ নভেম্বর ফিরে আসে দেশে।

অহনার প্রস্তুতির বিষয়ে কথা হয় তার প্রশিক্ষক এবং রোপফোরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের সঙ্গে। এত অল্প বয়সে পর্বতারোহণের চ্যালেঞ্জ কীভাবে সামলাল ১০ বছরে অহনা? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে পর্বত আরোহণের সময়ে অন্যান্য দেশের ছোট্ট বালকবালিকাদের উপস্থিতি চোখে পড়লেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন নজির ছিল না। পর্বতারোহণের জন্য শারীরিকভাবে যতটুকু যা প্রয়োজন তা কম বয়সে মানব দেহে সবচেয়ে বেশি থাকে। অহনার আগ্রহ এবং আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ সম্ভব করেছে দেশের সবচেয়ে কমবয়সী বালিকার সফলভাবে অন্নপূর্ণা পর্বতশৃঙ্গের বেজ ক্যাম্প আরোহণ।

মাকে ছাড়াই ছিল অহনার ১১ দিনের যাত্রা। মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কতটুকু ছিল? মা মেহজাবিন ইবানা বললেন মেয়ের মানসিক দৃঢ়তার কথা। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে তার ক্লান্তি থাকত না। তাই মেয়েকে নিয়ে আমি আশাবাদী ছিলাম। এবার বাসায় ফিরে সে আমাকে জানিয়েছে, ভবিষ্যতে আবারও পর্বতারোহণে যেতে চায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মার্ট আইনি সেবা কার্যক্রম চট্টগ্রাম থেকেই ছড়িয়ে পড়ুক সমগ্র দেশে
পরবর্তী নিবন্ধমিধিলির প্রভাবে ২৫৪ হেক্টর আমন ও রবি শস্য ক্ষতিগ্রস্ত