অহংকার, অর্জন ও বিসর্জনের মার্চ

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী | সোমবার , ৭ মার্চ, ২০২২ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

সীমাহীন অহংকার, ঐতিহ্য আর প্রত্যাশার মাস মার্চ মাস। বাঙালি জাতিসত্তা এবং বাংলাদেশের বিশ্বয় ও অহংকারের মাস মার্চ মাস। ৫০ বছর আগে সারা বিশ্বের জাগ্রত জনতার বিশ্বয় এবং বাঙালির অহংকার হয়ে, বাঙালির সর্বাত্মক বিসর্জনের মাস হয়ে এ মাস বছর ঘুরে আসে বাঙালি সর্বস্তরের মানুষকে আলোড়িত, অহঙ্ককৃত, উল্লাসিত, উদ্বেলিত করতে।
২০২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ বাঙালির মুক্তির ৫১ তম মার্চ। ৫০ বছর আগে টুঙ্গিপাড়ার দেবশিশু ৫১ বছর বয়সের শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়ে, জাতির পিতা হয়ে যে মহান মন্ত্রে ব-দ্বীপ ভূখণ্ডের হাজার বছরের শোষিত এই জাতিকে জাগিয়েছিলেন। তারই উজ্জ্বল আলোর উদ্ভাসে বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্ব জেগেছিল, শোষিত-বঞ্চিত মানুষ আশাবাদী হয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছিল। বাঙালির নেতা, নিপীড়িত মানুষের নেতা, মানবতার নেতা হাজার বছরের শোষণ থেকে বাঙালিকে মুক্ত করেছিল। মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। মুক্তির মন্দিরে সোপান তলে লাখো প্রাণের বিসর্জন দিয়ে এদেশ পাকিস্তানী শাসকদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
৫০ বছর আগের যে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ জেগে ছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই। শিক্ষাজীবনকে অসমাপ্ত রেখে, পারিবারিক জীবনকে অরক্ষিত রেখে, পিছনে ফেলে, সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথে নিবিড় ও দৃঢ়ভাবে হেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার খোকা। এ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে জাগিয়েছিল মহামন্ত্রে, মুক্তির মন্ত্রে।
১৯৭১ খ্রি. মার্চ মাসের ১ তারিখে পূর্বে আহুত এবং কাঙ্‌ক্িষত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। শুরু হয় দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল। অধিকার আদায়ের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির আন্দোলন।
খুব দ্রুত এ আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। বায়ান্নের ভাষার বঞ্চনা, চুয়ান্নের স্বরাজের বঞ্চনা, আটান্নের ববর্র আইয়ুবী শাসন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ত্রিমাত্রিক আন্দোলন শুরু হয়।
কারাগার এবং তার বাইরে সে স্বতঃস্ফূর্ত আসা-যাওয়ার নির্মোহ নেতৃত্ব দিয়ে ৬৫ সালের জাতীয়তাবাদী জাগরণ বাঙালি জনতার মননে পৌঁছে যায়।
শেখ মুজিবুর রহমানের নিরলস, ঐকান্তিক, ধারাবাহিক, নির্মোহ আন্দোলনের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষিত হয়। এই দেশের মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির প্রত্যাশার জাতীয়তাবাদী যাত্রা শুরু হয়। ষড়যন্ত্রের দেয়াল যতই দৃঢ় হয় বাঙালির প্রতিরোধ ততই তীব্র হয়। এভাবেই সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে দিয়ে পাকিস্তানের সমাধিসৌধ রচিত হতে থাকে। অন্যদের সাথে কতিপয় বাঙালি নেতৃত্বে ২৩ বছর আগে যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, তা এই মার্চ মাসে এসে নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। এই মার্চ মাসেই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ হয়, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তি তৈরি করা হয়। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
অবাধ অনুভূতির বিস্ফোরিত বাঙালি জাতিসত্তা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ছলচাতুরিকে ছিন্ন করে তীব্রভাবে জাতিসত্তার মশাল হাতে নিয়ে বের হয়ে আসে।
মাচের্র ৭ তারিখে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে অগণিত মানুষের সামনে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক বক্তব্য পেশ করেন।
প্রায় ১৯ মিনিটের এ ভাষণে তিনি ১১০৮ টি শব্দ ব্যবহার করেন। অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী, তীব্র-তীক্ষ্‌ণ বাক্য এবং বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি লাখো জনতা কে তাঁর চেতনা, দর্শন, করণীয়, পালনীয় সম্পর্কে স্পষ্টভাবে দিক নির্দেশনা দেন।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের মত গান্ধীর অহিংসা আন্দোলনের পাঠের দর্শনকে জনগণের সামনে তুলে ধরেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সশস্ত্র আন্দোলনের শিক্ষা থেকে জনগণকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর গেরিলা কৌশল এবং বিশ্বের অপরাপর নেতাদের দেশপ্রেমের, মানব মুক্তির কৌশল ও প্রক্রিয়াগুলোকে উপযোগিতা ভেবে অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। এভাবেই তিনি বাঙালিকে তাঁর উপস্থিতি অথবা অনুপস্থিতিতে তীব্র মুক্তির আন্দোলনের জন্য তৈরি থাকার নির্দেশ দেন।
বাঙালির জাতিগোষ্ঠীর সর্বকালের সেরা বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত দূরর্দশিতার সাথে হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ৭ ই মার্চের দুনিয়া কাঁপানো বাণী বিশ্বমানবতার জন্য বিবৃত করেন।
সময়ে, শব্দে, বাক্যে, ইতিহাস-ঐতিহ্যে, কাব্যি কতায়, তাঁর এ ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের শীর্ষে চলে এসেছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করে। ঐতিহ্য দলিলের এই উপলব্ধি, এই অবর্জনীয় সত্যকে গ্রহণ করতে ইউনেস্কোর লেগে যায় ৪৬ বছর ৭ মাস ২৩ দিন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা ১০ লাখের অধিক। বক্তৃতার সময় ১৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। শব্দ সংখ্যা ১১০৮। শুরুর বাক্য, ভাইয়েরা আমার। শেষ বাক্য- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
ঐতিহাসিক এই ভাষণটি বিভিন্ন কারণে অবিসংবাদিত, অভূতপূর্ব এবং শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য। দেশের এবং দুনিয়ার এযাবৎকালের। এটি কালোত্তীর্ণ উদ্দীপক, উজ্জীবক, প্রেরণাদায়ী, আত্মবিশ্বাসে ভরা। আকৃতিতে নাতিদীর্ঘ, অলিখিত, শব্দশৈলী ও কাব্যিকতায় পরিশীলিত ও অপূর্ব। স্পষ্ট, পরিমিত, দিকনির্দেশনা পূর্ণ, ধর্ম- বর্ণ- গোত্র নির্বিশেষে জাতিসত্তার মুক্তিবাণী। স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত।
এতে জাতিসত্তার দীর্ঘপথের শোষণ ও বঞ্চনার দুঃখের দুঃখের ভারাক্রান্তি আছে। অপর্ণ ইচ্ছার অতৃপ্ত বিবৃতি আছে। তেইশে বছরের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাসের বর্ণনা আছে। পাকিস্তানি নব্য উপনিবেশিকদের দায়িত্বহীনতার কাহিনী আছে। সর্বাত্মক অসহযোগ ও ক্ষোভের কথা আছে। হানাদারদের নির্তামমতা ও অপকৌশলের বিবৃতি আছে।
নিজের নির্মোহতার প্রত্যয় আছে। প্রশাসনিক নির্দেশনা আছে। শত্রুকে চিহ্নিত করার কৌশল আছে। আন্দোলনের কৌশলের কথা আছে। অসামপ্রদায়িকতার উদাত্ত আকাঙ্ক্ষার আহ্বান আছে। মহান স্বাধীনতার দাবি আছে। সর্বোপরি মুক্তির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার উদাত্ত ডাক আছে।
এটি আব্রাহাম লিংকনের তিন মিনিটের কম সময়ে ভাষণ, মার্টিন লুথার কিং এর ১৭ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণ কিংবা বিশ্বের স্মরণীয় সব বড় বড় নেতা-নেত্রীর ঐতিহাসিক বক্তব্যসমূহ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
২৩ বছরের ধারাবাহিক শোষণের শেকল ছিঁড়ে গণসচেতনতার উম্মেষ, মহামুক্তির উদাত্ত আহ্বান, বাঙালি জাতিকে দৃঢ়ভাবে সঙ্ঘবদ্ধকরণ, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের সকল প্রকার কৌশল, গেরিলা যুদ্ধের বর্ণনা দৃঢ়ভাবে বিধৃত হয়েছে।
১৯৭১ খ্রি. ৫ এপ্রিল প্রখ্যাত নিউজ উইক এর ভাষায় ‘পয়েট অব পলিটিঙ’ শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঐতিহাসিক ভাষণটি বিদ্রোহের অনন্যসাধারণ একটি কবিতা। এর প্রতিটি শব্দ ও বাক্যই এক একটি পারমাণবিক বিস্ফোরক। এর বাচনভঙ্গি, শব্দের তীব্রতা, গতি, এবং প্রতিধ্বনি চিরস্থায়ী উদ্দীপক, উজ্জীবক।
এই ভাষণের বিস্ফোরণ থেকে বাঙালি ঘর ছেড়েছে, বিপন্ন হয়েছে, স্বাধীনতাকে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরেছে।
নিরস্ত্র বাঙালি নৈতিক ও মানসিক দিক থেকে সশস্ত্র হয়েছে। অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু প্রত্যেকের মনে যে তীব্রতার সৃষ্টি করেছে, তাতে তাঁর অনুপস্থিতি আরো বহুগুণে উপস্থিত হয়েছে। ২৬৬ দিনের মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বৃহৎ দুইটি শক্তিকে নৈতিকভাবে পরাজিত করে বাঙালি হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। মার্চের প্রতিটি দিন বাঙালিরকে নতুন করে প্রত্যয় দীপ্ত করেছে, তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা ভেস্তে গেছে। ভুট্টোর ষড়যন্ত্র তলিয়ে গেছে। আন্ত ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সকল প্রকার ষড়যন্ত্র ধুলিস্যাৎ হয়েছে। বাঙালি জাতিসত্তার উত্থানের এ মাস অহংকারের মাস। অর্জনের মাস। আত্মতৃপ্তির মাস। দুঃখ ও বেদনা থেকে উল্লাস, উদ্ভাস ও অর্জনের মাস। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই এ মাস থেকে নয় মাসে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া সকল বীর যোদ্ধাদের। গভীর শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হাজারো মার্চের উল্লাসে উদ্ভাসিত হোক স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক

পূর্ববর্তী নিবন্ধধ্বংসের মুখে দেশের জীববৈচিত্র্য : বিরূপ ফলাফলের মুখোমুখি আমরা
পরবর্তী নিবন্ধ৭ই মার্চের ভাষণ: কালজয়ী ঐতিহ্যের নবদিগন্ত