অহংকারের বিজয় সর্বজনীন বিজয়

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার। এরপরে যা কিছু পরিবর্তন যা কিছু ঘটেছে তাকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে হবে। কারণ আমাদের ইতিহাসে এর চাইতে বড় কোন ঘটনা আজ পর্যন্ত ঘটেনি। এই মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল বিজয়। যা আমাদের আরেক গৌরব। আমরা স্বীকার করি যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম যে ব্যবস্থা যে শুভবোধ আমাদের চাওয়া তার অনেক কিছুই হয় নি। জাতি পায়নি মাথা তুলে বাঁচবার অধিকার। কিন্তু দেশ পেয়েছি আমরা। সেই দেশ যার বিরুদ্ধে বৃহৎ প্রতিবেশীর হুমকিকেও আমরা হেলায় উড়িয়ে দিতে পারি। কারণ আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয় কোনো চুক্তির ভেতর দিয়ে আসে নি। রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

স্মরণ করবো ফরাসী বিপ্লবের কথা: কোনো সমাজ ব্যবস্থা যখন জরাজীর্ণ এবং গতিহীন হয়ে পড়ে, তখন সমাজের মধ্য থেকে এমন শক্তি জেগে ওঠে যে তার আঘাতে পুরাতনতন্ত্র তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙে পড়ে। ক্ষয়ধরা সমাজকে ভেঙে পুরাতন ব্যবস্থার স্থলে নতুন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজের এই তৎক্ষণাৎ মৌলিক পরিবর্তনই হল বিপ্লব। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকেরা বিপ্লবের একটি বিশেষ অংশ দেখেন। তাদের মতে, সমাজে দুটি শ্রেণি থাকে। এক শ্রেণি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এবং অপর শ্রেণি শোষিত হয়। শোষিত শ্রেণি শেষ পর্যন্ত অধিকারভোগী শ্রেণির প্রথাগত রাজনৈতিক এবং আর্থিক সকল অধিকার বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস করে। শ্রেণিসংগ্রামই বিপ্লবের বাহন। যেমনটি দেখা যায় ফরাসি বিপ্লবে, যেখানে অধিকারভোগী অভিজাত শ্রেণিকে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতাচ্যুত করে।

১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যে বিপ্লব দেখা যায়, তা কোনো আকস্মিক কারণে ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে যে ব্যবস্থা চলে আসছিল, তার সঙ্গে ফ্রান্সের বৃহত্তর জনসমষ্টির স্বার্থ যুক্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গঠনে তৎপর হয় সাধারণ জনগণ।

১৯৭১ সালেও জনগণের আশা বাস্তবায়নে সংঘটিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। শীতের হালকা কুয়াশায় ঢাকা এক সকালে বটতলা গ্রামের মানুষ নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের মনে চাপা উত্তেজনা দেশের পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। চারদিকে যুদ্ধের খবর। ডাকপিয়ন করিম চাচা সেই উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাইকেলে প্রতিদিন চিঠি বিলি করতেন। সাধারণ ডাকপিয়ন হলেও যুদ্ধের সময়ে তাঁর দায়িত্ব শুধু চিঠি পৌঁছে দেওয়া নয়; বরং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গুপ্তবার্তা বহন করাও।

করিম চাচার বয়স প্রায় ৫০। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট হলেও মন ছিল তরুণ। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে গভীর আস্থা নিয়ে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিত। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে সন্দেহ করত, ব্যাগ তল্লাশি করত। করিম চাচা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। গুপ্তবার্তা কখনো জামার ভাঁজে, কখনো শিশুদের খেলনার ভেতরে লুকিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দিতেন। ১৪ ডিসেম্বর খবর এল পাকিস্তানি সেনারা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। তারা সন্দেহ করছে, এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি আছে।

করিম চাচা জানতেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ঢাকায় বার্তা পাঠানো দরকার। রাতের অন্ধকারে সাইকেল নিয়ে তিনি বের হলেন। শীতের কুয়াশায় ঢাকা সেই রাত যেন এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ। করিম চাচা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বার্তা পৌঁছে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা তৈরি হও। কাল হয়তো গ্রামে শেষবারের মতো যুদ্ধ হবে।’

৬ ডিসেম্বর বটতলার মানুষ ঘুম থেকে উঠল বন্দুকের গুলির শব্দে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। গ্রামজুড়ে ভয় আর উত্তেজনার পরিবেশ। নারীরা পুকুরের পাড়ে লুকিয়েছে, পুরুষেরা লাঠি ও দা নিয়ে প্রস্তুত। করিম চাচা দেখলেন, পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের উত্তর দিক দিয়ে পালাচ্ছে। খবর পেয়ে রাজা আর হাসান সেই পথ দিয়ে তাদের আক্রমণ করল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ছড়িয়ে পড়ল বিজয়ের আনন্দ। (প্রথম আলো।)

এমন হাজার গল্প আছে আমাদের। বিজয়ের দু দিন আগে আমাদের দেশে সাংঘাতিক একটা কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল। মেধা শূন্য করার জন্য বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। এই যে নিদারুণ ঘটনা এ কি আমাদের ইতিহাস নয়? বিজয়কে মহান করে গেছে এই আত্মত্যাগ। যে রক্ত যে খুন সে রঙে রাঙানো বিজয় এসেছিল দু দিন পর। এখানেও আমাদের জন্য শেখার পাঠ আছে। যে দেশ যে সমাজ মেধা অভিভাবকত্ব আর অগ্রজদের লালন করতে জানে না তার বিজয় সুদূর পরাহত। এ কথা মনে রাখা দরকার অগ্রজের অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের তেজ নিয়েই চলে সমাজ। গঠিত হয় স্বপ্নের দেশ।

দুনিয়ার অনেক দেশে কষ্টার্জিত বিজয় এসেছে। ভিয়েতনাম সফরকালে কম্বোডিয়া গিয়ে লাওস ভ্রমণে আমি দেখেছি তারা কীভাবে তাদের যুদ্ধের স্মৃতি আর বিজয়কে আগলে রেখেছে। জাদুঘর যেন মূর্ত দলিল। আমাদের দেশে নির্মোহ ইতিহাস আর স্বচ্ছতাই পারে তেমন কিছু করতে। একপেশে কোনো কিছু টেকে না। তার প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে। তাই উচিৎ হবে সেখান থেকে পাঠ গ্রহণ করে ইতিহাস বিনির্মাণ ও সামনে এগিয়ে চলা।

আমাদের পরিচিত এক অগ্রজ ছিলেন এলাকায়। একাত্তরে তাঁকে কখনো দেখা যায় নি। সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি মারা গেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর সগৌরবে ফিরে এসছিলেন বিজয়ীর বেশে। কাঁধে রাইফেল হাতে পতাকা সেই ভাইকে কোনোদিন ভুলবো না। কিন্তু স্বাধীন দেশে কোনো সুযোগ সুবিধা না নিয়ে আবারো চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে। বলতেন, আমাদের কাজ আমরা করেছি এবার যাদের পালা তারা তাদের কাজ করুক। এমন যোদ্ধারাই আমাদের বীর। আমাদের ইতিহাস।

বিজয় বারবার ধরা দেয় না। যাদের ইতিহাসে এমন বিজয় আছে তারা ভাগ্যবান ভাগ্যবতী। আজ এত বছর পর আমাদের সামনে আবার দেশ গঠন আর মিলেমিশে থাকার ডাক এসেছে। কেন এসেছে সবাই জানি। এই সুযোগ হাতছাড়া না করে ইতিহাসকে অম্লান রেখে আমাদের উচিত সে ডাকে সাড়া দেয়া। বিখ্যাত দার্শনিক রুশো মনে করতেন জলাধারে কচুরিপানা থাকবেই। বুদ্ধির কাজ হচ্ছে তাকে জমতে না দেয়া। সময়মতো পরিষ্কার করে রাখা।

মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। যে ইতিহাস সবার যে বিজয় আমাদের বাঙালির যে বেদনা ও গৌরব জাতির তা থেকে তাকে পৃথক করা যাবে না। একপেশে একদর্শি একমুখিনতা থেকে মুক্ত হোক ইতিহাস। মুক্তি পাক আমাদের বিজয়গাথা। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Victory has many fathers defeat is an orphan .জয় যার ইতিহাসও তারই হয়।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয় দিবসের প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধকুতুবদিয়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান