অস্বাভাবিক সময়ে সাধারণ বাজেট

সিপিডির প্রতিক্রিয়া চাপে থাকা সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেট

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ৮ জুন, ২০২৪ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর যে লক্ষ্য নতুন অর্থবছরের বাজেটে নেওয়া হয়েছে, তা পূরণে বাস্তবসম্মত কোনো দিকনির্দেশনা অর্থমন্ত্রীর পরিকল্পনায় দেখছে না সিপিডি। বেসরকারি এ গবেষণা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের ভাষায়, চাপে থাকা সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথ দেখাতে প্রস্তাবিত বাজেট ব্যর্থ হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪২০২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন। ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ শিরোনামের এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি আগামী বছরের জুনের মধ্যে সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।

দীর্ঘদিনের রেওয়াজ মেনে বাজেটের পরদিন গতকাল শুক্রবার প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। আগে ব্র্যাক ইন সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলন হলেও এবারের আয়োজন ছিল আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি জায়গায় যন্ত্রণা আছে। সূচকগুলো অস্বস্তিতে রয়েছে। এমন অবস্থায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং তলানিতে যাওয়া রিজার্ভ উন্নয়নে। আগামী বাজেট বাস্তবায়নে যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো নেওয়া হয়েছে, তা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই, বাস্তবতাসম্মত নয়। সমস্যাকে মেনে না নেওয়ায় বাস্তবতার গভীরে যাওয়া হয়নি। বাজেট বাস্তবায়নে লক্ষ্যগুলো দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা নেই।

পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সংকট মোকাবেলায় বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো, রিজার্ভ বাড়ানো। আগামী ১২ মাসে কীভাবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়, এটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। দুই অংক ছুঁইছুঁই মূল্যস্ফীতির মধ্যে নিম্নআয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে বাজেটে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলেও মনে করছে সিপিডি।

অস্বাভাবিক সময়ে সাধারণ বাজেট : ফাহমিদা খাতুন বলেন, একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাজেট দেওয়া হলো। এঙট্রা অর্ডিনারি সময়ে অর্ডিনারি বাজেট দেওয়া হল, আমাদের প্রত্যাশা ছিল এই বাজেট অনেক উদ্ভাবনী হবে। এখানে সৃজনশীল ও কিছু সাহসী পদক্ষেপ থাকবে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জিং সময়ে গতানুগতিক বাজেট কোনো ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক উদ্বেগ মোকাবিলায় যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, বাজেটে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবারের বাজেট আমাদের কাছে অতীতের বাজেটের মতোই মনে হয়েছে। তার ভাষায়, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অনুধাবন করতে না পারায় বাজেটে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা দুর্বল ও অপর্যাপ্ত।

বাজেটের আকারের প্রশংসা : গত কয়েক বছর যে বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ১৫ শতাংশের ওপরে, সেখানে এবার তা ১৪ শতাংশের ঘরে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রায় এক দশক ধরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ থেকে শতাংশের ওপরে থাকছিল। এবার তা ৪.৬ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন মাহমুদ আলী। বাজেটের আকার খুব বেশি না বাড়ানোকে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, এবারের সংযত বাজেট ইতিবাচক।

প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ালেও কর ধাপে পরিবর্তন এনে মধ্যম আয়ের স্তরে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে। কর স্তর পুনর্বিন্যাস করাকে প্রগতিশীল হিসেবে বর্ণনা করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে একটু স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তারা একটু স্বস্তি পাবেন।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা : ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ ফিরিয়ে আনা হয়েছে বাজেটে, যেখানে সাধারণ নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ কর হার ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বিরোধিতা করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটা নৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নিয়মিত কর দেন, এর মধ্য দিয়ে তাদের তিরস্কৃত করা হচ্ছে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবার আয়কর আইনে একটি বিষয় সংযুক্ত করা হচ্ছে যে, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করলে পরবর্তীতে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না, কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বেলাতেও প্রযোজ্য হবে কিনা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সুশাসনকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা কর দিলেই তা বৈধ হবে, তার দুর্নীতি অনিয়মকে ধরা হবে না, এমন সুযোগ রাখা কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এখানে একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। কালো টাকার মালিকদের মাথায় হাত বুলানো হচ্ছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ : অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। তাতে তাতে আয় ও ব্যয়ের সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতোই বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি ঋণের ওপর। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে, যা বাজেটের ১৭ শতাংশের বেশি। ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এসফবিসিসিআইয়ের মতো সিপিডিও অর্থমন্ত্রীর এ পরিকল্পনা নিয়ে আপত্তি তুলেছে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের প্রতি নির্ভরতার কারণে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাবে কিনা, তা চিন্তার বিষয়।

সমালোচনা রিজার্ভ নিয়ে : বাজেটে আগামী অর্থবছর শেষে মোট রিজার্ভ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাব মন্তব্য করে ফাহমিদা খতুন বলেন, আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে কত হবে তা বলা হয়নি। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ৫ জুন রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বাজেটে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছে ১১৪ টাকা, যা গত ৫ জুন ছিল ১১৭ টাকা ৯৫ পয়সা। রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও টাকার মান বাড়ানো হচ্ছে, যা বোধগম্য নয়।

সরকার আগামী দিনে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে থাকতে পারেএমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমান সংকটের সময়ে টাকার মান বাড়বে কীভাবে তা বোধগম্য না।

ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক : আওয়ামী লীগ এ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাজেটে তার কতটা প্রতিফলন হয়েছে, সেই প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেই। পণ্য সরবরাহ বাড়াতে আমদানি পর্যায়ে যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে তা ব্যবসায়ীরা পাবেন। ভোক্তা শ্রেণি অতীতের মতো এবারও পাবে না। বাজার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও তদারকি না বাড়ালে তা হবে না।

আর্থিক খাতের সুশাসন প্রশ্নে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট বলা হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে থাকবে সরকার। কিন্তু বাজেটে কর ও ঋণ খেলাপিসহ দুষ্টচক্রকে মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের টাকা অর্থনীতিতে আনার প্রচেষ্টায় কর হার কমানো হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সংসদ সদস্যরা হতে পারেন উদাহরণ : রাজস্ব আয় মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে বাড়াতে না পারায় বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্ব নীতি এখন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী চক্রের জন্য হয়ে গেছে। এখন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর জন্য কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগামী বাজেটে এমপিদের জন্য গাড়ি আমদানিতে শুল্ক কর বসানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এখন তারা কর দিয়ে উদাহরণ হতে পারেন, কৃচ্ছ্র সাধনের সময়ে তাদেরও অংশগ্রহণ হোক।

রাজস্ব বাড়াতে ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাইজেশনে ২২ পয়সা বিনিয়োগ করলে ১০০ টাকা কর আদায় করা সম্ভব বলে এনবিআর চেয়ারম্যান উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন দিয়েছেন। অন্যান্য ৩৩টি এলডিসি দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ডিজিটাইজেশন খরচ অনেক কম। আমাদের এ খাতে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

সিপিডির উপস্থাপনার উপসংহরে বলা হয়, আগামী ২০২৪২৫ অর্থবছরের বাজেট চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দরিদ্র ও নির্ধারিত আয়ের জনগোষ্ঠীকে স্বস্তি দিতে নেওয়া পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একটি নতুন সরকারের পুরনো বাজেট হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে থাকা মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বাজেট কৌশলে মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেননি। এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতি মূল ধারায় ফিরে আসবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ কাঁদানে গ্যাস, ফাঁকা গুলি
পরবর্তী নিবন্ধ২২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা তাদের আর সহ্য হচ্ছে না