অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার

নিত্য নতুন অজুহাত

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৭ মার্চ, ২০২২ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

দিন দিন বেড়েই চলেছে ভোজ্যতেলের উত্তাপ। চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে পাইকারিতে চাঙা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম। যদিও আমাদের দেশে পাম তেল আসে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং সয়াবিন আসে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ভোক্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক অজুহাত দাঁড় করিয়ে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির করে তুলছেন। তবে খাতুনগঞ্জের তেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া সূর্যমুখী তেলের বড় রপ্তানিকারক দেশ। সেই দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিভিন্ন দেশে পাম ও সয়াবিন তেলের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর বাড়ে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৬৮০ টাকায়। যা গত এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫ হাজার ১২০ টাকায়। অন্যদিকে বর্তমানে প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৬ হাজার ২৭০ টাকায়, যা গত এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫ হাজার ৯০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের কয়েকজন তেল ব্যবসায়ী জানান, খাতুনগঞ্জের বাজারে পণ্য বেচাকেনা ও লেনদেনে যুগ যুগ ধরে কিছু প্রথা চালু আছে। নিজেদের সুবিধার অনেক প্রথা আছে যেগুলো আবার আইনগতভাবেও স্বীকৃত নয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) স্লিপ। তেল কিংবা অন্য কোনো পণ্য কেনাবেচায় ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে বিভিন্ন আগাম লেনদেন হচ্ছে। দেখা যায়, পণ্য হাতে না পেলেও ওই ওই স্লিপটিই বেচাকেনা হচ্ছে। কোনো কোম্পানি বাজার থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের ডিও কিনে নেয়। যে দরে ডিও কেনা হয়, তার বাজার দর যদি বেড়ে যায়, তখন পণ্যটি ডেলিভারি দিতে তারা গড়িমসি করে। আবার দেখা যায়, কোম্পানির পণ্যই আসেনি কিন্তু ডিও কিনে রেখেছেন অনেক বেশি। এর ফলেও কোম্পানি বাজারে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না। ফলে এসব পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এক্ষেত্রে তেল ও চিনির ডিও বেচাকেনা বেশি হয়। বলা যায় ডিও কারসাজির কারণে মাঝে মাঝে পণ্যের দাম আকাশচুম্বি হয়ে ওঠে।
জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী ফেরদৌস ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় এখনো আমাদের খাতুনগঞ্জে তেলের দাম কম। বুকিং দর অনুযায়ী কেবল পাম তেলের দাম মণপ্রতি ৭ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের এ সব তেল আগের কেনা বলে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। গত এক বছর আগে সয়াবিন তেলের বুকিং ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ ডলার। কিন্তু বর্তমানে সেটি ১ হাজার ৮০০ ডলারে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বাজার ছাড়াও ডলারের দাম বৃদ্ধি ও পণ্য পরিবহনের খরচও বেড়েছে। এর ফলে তেলের আমদানিও খরচ বেড়ে গেছে।
খাতুনগঞ্জের আরেক তেল ব্যবসায়ী মো. আবু বক্কর দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা তেল আমদানি করি না। তেলের বাজার দেখা যায়, সকালে এক দর আর বিকেলে আরেক দরে কিনতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামার কারণে দেশের বাজারেও তার প্রভাব পড়ছে।
মো. ফরিদ উদ্দিন নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, এক লিটার সয়াবিন তেল কিনতে হচ্ছে এখন খরচ হচ্ছে ১৭০ টাকা। দাম বাড়ার কারণে খোলা তেল কেনা শুরু করেছিলাম। এখন সামনে থেকে খোলা বিক্রি করা যাবে না বলে সরকার জানিয়ে দিয়েছে। তেলের বাজারে মনে হয় না সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে। ব্যবসায়ীরা কিছুদিন পর পর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে, পরে এক সময় সরকার তাদের সেই প্রস্তাব মেনে নিয়ে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ভোজ্যতেলের বাজার দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আবার খোলা তেল বিক্রি বন্ধ হওয়ার ঘোষণা আসা দরিদ্র মানুষজনের কপালেও ভাঁজ পড়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তারপরেও ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর একদিনের ব্যবধানে সয়াবিন-তেলের দাম মণে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এ ছাড়া আমদানি মূল্যের সাথে বিক্রয়মূল্যের বিরাট ফারাক লক্ষ্য করা যায়। তবে ভোজ্যতেলের বাজারে যেভাবে তদারকি হওয়া দরকার সেটিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের উচিত নিয়ম করে তেলের বাজার মনিটরিং করা।
রাউজানে ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকট : আমাদের রাউজান প্রতিনিধি জানান, বাজারে তেল সরবরাহ নেই এমন অজুহাতে রাউজানের অধিকাংশ দোকানে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন দোকানিরা। আবার কিছু কিছু বড় দোকানি তেল নেই বলে ক্রেতাদের ফেরত দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, বড় দোকানিরা আগের কেনা তেল গুদামে মজুদ করে রেখেছেন রমজানে বাড়তি ফায়দা পেতে।
গতকাল রোববার রাউজান উপজেলা সদরের বড় বাজার ফকিরহাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ৮০ টাকা, পাঁচ লিটার বোতলের দাম সাড়ে আট’শ টাকা। এই বাজারের কয়েকটি বড় দোকানি সয়াবিন নেই বলে ভোক্তাদের ফেরত দিচ্ছেন। ভোক্তাদের অভিযোগ কিছু কিছু দোকানি অল্প কয়েকটি তেলের বোতল দোকানে সাজিয়ে রেখে সরবরাহ না থাকার অজুহাত দাঁড় করিয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন। বড় দোকানীরা নিজস্ব গুদামে তেলে মজুদ করে সংকট সৃষ্টি করছেন বলেও অভিযোগ ভোক্তাদের। উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোট দোকানগুলোতে কমবেশি তেল পাওয়া গেলেও বড় দোকানগুলোতে তেলের দেখা মিলছে না। কাগতিয়া বাজার, নোয়াপাড়া পথেরহাট, গৌরি শংকর হাট, পাহাড়তলী ও গহিরা চৌমুহনীর বড় দোকানগুলোতেও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এই ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির সোহাগ বলেন, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামবে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউক্রেনে বন্দি পাঁচ বাংলাদেশিকে ফেরানোর আশ্বাস মোমেনের
পরবর্তী নিবন্ধ৭ মার্চের ভাষণে জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ও প্রকাশ পায়