অস্থিতিশীল জ্বালানি খাত এবং অন্তর্বর্তীকালীন গ্যাস বিপণন নীতিমালা প্রসঙ্গে

নেছার আহমদ | বুধবার , ১২ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্বে জ্বালানি খাতকে অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির ত্রাহি অবস্থায় বাংলাদেশের জ্বালানি খাতেও এর প্রভাব পড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি, দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র সমূহ হতে চাহিদানুযায়ী গ্যাস না পাওয়া, এলএনজির বিশ্ব বাজারের উত্থানপতন প্রভৃতি কারণে দেশে গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় নানাবিধ কারণে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এক লাফে ডাবলের চেয়ে বেশি গ্যাস মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পও মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গ্যাস বিপণন কোম্পানী সমূহের একশ্রেণির অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তাদের কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আরো মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পতিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিপণন কোম্পানীগুলো সরকার গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সেখানে পেট্রোবাংলার ন্যায় একটি মাথাভারী প্রসাশনের উপস্থিতি নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা হতাশ। বিপণন বা বিতরণ ব্যবস্থাপনায় যদি বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয় সেখানে পেট্রোবাংলার কার্যক্রম নিয়ে কথা তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে পেট্রোবাংলা বিপণন কোম্পানীসমূহে তদন্তের নামে হয়রানি, চিঠি আদান প্রদানকারী এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্মবিহীন পেট্রোবাংলাকে বিলুপ্ত করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোম্পানীগুলো সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে বলে মতামত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞমহল।

জ্বালানি সেক্টরের সকল নিয়মকানুনের বিষয়ে এবং জ্বালানি ব্যবহারে সরকার নতুন পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে দীর্ঘ দিন আগে কিন্তু এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর মধ্যে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে বেসরকারি উদ্যোক্তরা জ্বালানি আমদানি করে বিপণন করতে পারবে। এতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির বিষয়টিও রয়েছে। ফলে গ্যাস বিপণনে নতুন বিধি যুক্ত করে নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চললেও বিগত কয়েক বছরেও এ বিধিমালা চূড়ান্ত হয়নি। নতুন গ্যাস বিপণন বিধিমালা ২০১৯ এর খসড়া দেশের সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য জ্বালানি বিভাগের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হলেও এ বিষয়ে কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। গ্যাস ব্যবহারের শুরু থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিতরণ কোম্পানীভিত্তিক প্রণীত নিয়ম অনুযায়ী গ্যাস বিপণন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে সব বিতরণ কোম্পানীর জন্য গ্যাস বিপণন নিয়মাবলী ২০০৪ কার্যকর করা হয়। পরবর্তীতে অন্তবর্তী ব্যবহার হিসেবে গ্যাস বিপণন নিয়মাবলী২০১৪ প্রস্তুত করা হয়।

বর্তমানে গ্যাস বিপণন নীতিমালা যেন হয়রানির একটি মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। কর্তকর্তারা এ নীতিমালাকে ব্যবহার করে গ্রাহক হয়রানি করে আসছে। যদিওবা এ নীতিমালাটি এখন সময়ের ধারাবাহিকতায় অকার্যকর বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।

নীতিমালা২০১৪ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের (আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, সিএনজি, ক্যাপটিভ, চা বাগান বা অন্যান্য) যে সুযোগ সুবিধা বা সেবা প্রদানের ধারাসমূহ সম্পৃক্ত রয়েছে। বর্তমানে কর্মকর্তারা সে ধারা সমূহ অনুসরণ বা বাস্তবায়ন করেন না, অনুমোদনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ক্ষমতা দেওয়া হলেও তার কার্যকারিতা নেই। ক্ষমতা নিয়ে নেয়া হয়েছে কোম্পানীর পরিচালনা বোর্ডে। বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত সার্কুলার বা বিজ্ঞপ্তি এবং মন্ত্রণালয়ের সময়ে সময়ে দেয়া নির্দেশনা সমূহ অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন দেয়ার নিয়ম চলছে। কিন্তু যখন বিভিন্ন ক্যাটাগরির গ্রাহকদের জরিমানা আদায় বা তাদের উপর অন্যায়ভাবে বিভিন্ন নিয়মকানুন নিরাপত্তা জামানত আরোপিত করা হয় তখন গ্যাস বিপণন নীতিমালা২০১৪ অনুসরণ করা হয় যা একটি স্বাধীন দেশের জন্য অনৈতিক ও অমানবিক কর্মকাণ্ড। এ ব্যাধিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত চট্টগ্রামের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লি.’ যা বর্তমানে চট্টগ্রামের সকল শ্রেণির গ্রাহকদের জন্য অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য গ্যাস বিপণন কোম্পানী প্রতিষ্ঠার মতো ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লি.’ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি লক্ষ্য ও আদর্শ এবং চট্টগ্রামের মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের গ্রাহকদের জন্য একটি প্রতিজ্ঞা ও উদ্দেশ্যে নিয়ে এ কোম্পানী যাত্রা শুরু করে। গ্রাহক হয়রানি এবং আইনের অসামঞ্জস্য এবং শিল্প মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং গ্রাহককে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লি.’ প্রতিষ্ঠা হয়। শিল্পে সংযোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, জামানত বেশি আদায়, গ্যাস নীতিমালা২০১৪ অকার্যকর প্রভৃতি বিষয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাসের দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।

৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ এবং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে এ কোম্পানী আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর থেকেই ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ’ হতে আশানুরূপ সেবা জনগণ পায়নি। শুরুর পর হতে গ্যাস সংকটে ত্রাহি অবস্থা। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে বার বার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়নি চট্টগ্রামের জনগণ। ২৮/০২/২০১৮তারিখে চট্টগ্রাম চেম্বারের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষে ব্যবসায়ীদের সাথে মাননীয় জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিকএলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম) এবং সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিনিময় সভায় অনেকগুলো সুপারিশমালা গৃহীত হয়।

এ সুপারিশের প্রেক্ষিতে দেশের অথবা গ্যাস বিপণন কোম্পানীসমূহ সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করে ২ মাসের সমপরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু কেজিডিসিএল এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তিত মনোভাব না দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত মনগড়া আইন তৈরি করে এবং পূর্বের ন্যায় ৩ মাসের/৬ মাসের জামানত গ্রহণ করে আসছে। কর্মকর্তাদের মাঝে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিদ্বেষী মনোভাব কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সুপারিশ অনুযায়ী দেশের অন্যান্য বিপণন কোম্পানীতে ১/২ মাসের সমপরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা জামানত হিসেবে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেজিডিসিএল নিজস্বভাবে সকল নিয়মকানুন উপক্ষো করে ৩ মাসের/৬ মাসের সমপরিমাণ অর্থ আদায় করছে। চট্টগ্রাম চেম্বারের সুপারিশ অন্য কোম্পানীতে বাস্তবায়িত হলেও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাসে তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ বিষয়গুলো চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ হতে দেখভাল করার প্রয়োজন ছিল। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীর জন্য গ্যাস বিপণন নীতিমালা২০১৪ যেন গ্রাহক হয়রানির একটি মারাত্মক অস্ত্র। এ অস্ত্র ব্যবহার করে চট্টগ্রামে গ্রাহক হয়রানি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

২০১৮ হতে এখন পর্যন্ত উপদেষ্টা কমিটি এবং পরবর্তীতে কেজিডিসিএল বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অনেক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ কার্যক্রম গৃহীত হয়নি বরঞ্চ বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তের নামে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা হচ্ছে।

বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রাহকদের কোনো আবেদন অনুমোদন হয়নি। অনেক আবেদন এবং জ্বালানি উপদেষ্টা কর্তৃক অনুমোদিত অনেক প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানিমূলকভাবে এখনো সংযোগ প্রদান করা হয়নি, বরঞ্চ এ বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা তৈরী করা হয়েছে। এছাড়া বেজা, কোরিয়ান ইপিজেড এবং চট্টগ্রাম ইপিজেডেরও অনেক আবেদন দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে আছে। কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।

সম্প্রতি পুনঃসংযোগ, নাম পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন জনিত অনুমোদন নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। নাম পরিবর্তন বা পুনঃসংযোগ নিতে গেলে ভূমির কাগজপত্র পরীক্ষার নামে ভূমি অফিসের ছাড়পত্রের ন্যায় নব্য আইন চালু করেছে কেজিডিসিএল। যা দেশের অন্যান্য বিপণন কোম্পানীতে চালু নেই।

গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে এবং শিল্প বিনিয়োগকারীদেরকে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান না করার ফলে শিল্পায়নে আস্থাহীনতা তৈরী হয়েছে। এতে সরকারের শিল্পনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম শিল্প নগরী, চট্টগ্রাম বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। অথচ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব বিনিয়োগে গড়ে উঠা শিল্প এলাকা সমূহে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে।

গ্যাস ট্যারিফ বৃদ্ধি জনিত জামানত আদায়ের জন্য অন্য কোনো কোম্পানী এখনো কোনো কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কিন্তু কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ বর্ধিত জামানতের জন্য সংযোগ প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক বিল পরিশোধ করতে পারছে না সেখানে জামানতের জন্য চাপ দেয়া কর্মকর্তাদের অতি উৎসাহী মনোভাব হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে বিনিয়োগকারী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়।

সময়ের প্রয়োজনে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংযোগ এবং পুনঃ সংযোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা পরিহারে কেজিডিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ক্ষমতা প্রদান করা জরুরি। সাথে সাথে চট্টগ্রাম বিদ্বেষী ও দায়িত্ব পালনে অনীহা পোষণকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লি.’ কোম্পানীটি বর্তমানে যেন আন্তরিকতার সংকটে ভুগছে। বর্ণিত বিষয়াবলী দ্রুত সমাধান পূর্বক চট্টগ্রামের গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ