অস্তিত্ব অন্বেষা : চর্যাপদের উৎসভূমি চট্টগ্রাম ও পণ্ডিত বিহার

ড. সবুজ বড়ুয়া শুভ | বৃহস্পতিবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রেক্ষাপট: চৈত্যগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম।

বাংলার ইতিহাস বিশেষ করে চট্টগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। পাহাড় আর সাগরবেষ্টিত বাংলার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের এই জনপদ বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকেই। সেই সময় এখানকার পাহাড়পর্বতে ও সমতলে অসংখ্য বিহারমন্দির বা চৈত্য গড়ে উঠেছিল বলে এই রম্যভূমি ‘চৈত্যগ্রাম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর এই চৈত্যগ্রামের অপভ্রংশ রূপ হচ্ছে চট্টগ্রাম। বাঙালি জাতিসত্তার এবং বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রধান বাহন হলো তার গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য ও চলমান বর্তমান, তেমনি চট্টগ্রামের রয়েছে তেমনি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে, এই সমতট জুড়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে যে ধারা প্রবহমান ছিল, দেদীপ্যমান ছিল। যা এদেশের জাতিসত্তাকে সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ করেছে। আবহমানকাল ধরে এখানে একে একে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, গোত্রের অনুসারিদের জীবনযাত্রায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে আজকের আধুনিক চট্টগ্রাম।

চর্যাপদের উৎসভূমি চট্টগ্রাম ও পণ্ডিত বিহার: আমাদের অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় পণ্ডিত বিহারের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল তাৎপর্যমণ্ডিত একটি সুন্দর আন্তর্জাতিকমানের বিদ্যাপীঠ কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল এবং তার সঠিক অবস্থান চট্টগ্রামের কোথায়, তা এখনো সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি বা করা যায়নি। বিশ্ববিশ্‌রুত তিব্বত বিদ্যাবিশারদ চট্টগ্রামেরই কৃতীসন্তান রায়বাহাদূর শরৎচন্দ্র দাশ মহোদয় ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে কয়েকবার তিব্বত গিয়ে বহু পুঁথিপত্র এনে প্রচুর গবেষণা করে এবং পরিভ্রমণ করেও পণ্ডিত বিহারের সঠিক অবস্থান কোথায় তা চিহ্নিত করতে পারেননি। তাঁর মতে চট্টগ্রাম শহরের দেবপাহাড় এলাকাতেই পণ্ডিত বিহারের অবস্থান ছিল। রায়বাহাদূর শরৎচন্দ্র দাশের তিব্বতের দুঃসাধ্য ভ্রমণের পুরস্কার হিসেবে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট তাঁকে পণ্ডিত বিহারের লুপ্ত গৌরব উদ্ধারের জন্য দেবপাহাড়ের কিছু অংশ দিয়েছিলেন। তা থেকে প্রায় দু’একরের বেশি পরিমান জায়গা তৎকালীন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতিকে দান করে যান। চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের তদানীন্তন অধ্যক্ষ শ্রীমৎ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের কাছে দানপত্রের দলিল হেফাজতে ছিল বলে জানা যায়।

বিশ্ববিশ্রুত বৌদ্ধ মনীষী, এশিয়ার প্রথম ডিলিট ড. বেনীমাধব বড়ুয়া, আইনজীবী উমেষ চন্দ্র মুৎসুদ্দি, সাংবাদিক সাহিত্যিক বিমলেন্দু বড়ুয়া এবং অন্যান্য গবেষকবৃন্দ পরবর্তীকালে বিক্ষিপ্তভাবে পণ্ডিত বিহার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালান। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন পণ্ডিত বিহারের অবস্থান আন্দরকিল্লার রঙমহল পাহাড় এলাকায়, যেখানে জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ করার সময় একটি বিরাট বুদ্ধমূর্তিসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন সেখানে পাওয়া গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকের মতে সেটার অবস্থান ছিল চক্রশালায় অথবা দেয়াং পাহাড় এলাকায়। তবে বেশির ভাগ গবেষকদের অভিমত যে দনুজমর্দন দেব, মোট সুন্দ, বসু দেব প্রমুখ দেববংশীয় রাজাদের ১২৭৯ খৃঃ পর্যন্ত স্মৃতিধন্য দেবগ্রাম যা অপভ্রংশ হয়ে দেয়াং নামে পরিচিতি লাভ করে সেখানেই পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল।

ব্রিটিশ আমলে সেই দেয়াং পাহাড়ের নিকটবর্তী এলাকায় বর্তমান আনোয়ারার ঝিউরী নামক গ্রামে পুকুর খনন ও গৃহ নির্মাণকালে এক সংগে অর্ধশতাধিক বিভিন্ন আকারের বুদ্ধমূর্তি প্রাপ্তি এবং সাম্প্রতিককালে ঐ এলাকারই কাছাকাছি পটিয়ার (বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলাধীন) বড় উঠানে গবেষক সুনীতি কানুনগো কর্তৃক রাজা কান্তি দেবের একটি তাম্রশাসন লিপি উদ্ধার আমাদের ইংগিত দেয় যে দেয়াং পাহাড় এলাকাতে পণ্ডিত বিহারের স্বর্ণালী অস্থিত্ব, যা মাটির তলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে রয়েছে। খৃষ্টীয় ৮ম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত পাল, চন্দ্র, দেব, আরকানী প্রভৃতি বৌদ্ধ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পণ্ডিত বিহার সগৌরবে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। নালন্দা ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ধ্বংস হয়ে যাবার পর পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ই পূর্ব দেশীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত মণ্ডলীর আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। কিন্তু ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে চট্টগ্রামের উত্তর পশ্চিমাংশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও, ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যভূক্ত থাকে। এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর তুর্কী আক্রমণের করুন ট্রেজেডির পুনরাবৃত্তি এ অঞ্চলেও ঘটবে আশংকা করে পণ্ডিত সিদ্ধাচার্যরা নেপালে, তিব্বতে, বর্মায় পুঁথিপত্র নিয়ে দলে দলে পালিয়ে যান। পণ্ডিত বিহার হয়তো মোগল ও পর্তুগীজ নৌ সৈন্যদের গোলার আঘাতে একেবারে ধূলিসাৎ হয়, নতুবা অযত্নে অবহেলায়রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমশ জীর্ণশীর্ণ হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কিন্তু পরিণতি যাই হোক না কেন, প্রত্নতাত্বিক উৎখননের মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে যদি পণ্ডিত বিহারের অস্থিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে শুধুমাত্র ধর্মসংস্কৃতির নয়, বাংলাভাষার আদি উৎস পর্যায়ের এক নতুন দিক উন্মোচিত হবে এবং সেই সাথে সংযোজিত হবে ইতিহাসের এক অভিনব অধ্যায়। চর্যাপদের উৎসভূমি চট্টগ্রাম এবং এই পণ্ডিত বিহারই হচ্ছে তার সূতিকাগার।

এই উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল ১৮০ বছর, বাংলায় মোগল শাসন আরো কম সময়ের। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের স্থায়িত্ব দু’শ বছরেরও কম। অথচ আমাদের ইতিহাসের সিলেবাসের সিংহভাগ জুড়ে দেখানো হয় সেই মোগল ইতিহাস ও ব্রিটিশ যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নতি। বাঙালির ইতিহাস চর্চায় ব্রিটিশ আগমন পরবর্তী বাংলার নব জাগরণকে এ ভাবে দেখানো হয় যাতে মনে হয় ব্রিটিশ আসার আগে বাংলায় শিক্ষাসাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি ইত্যাদিতে বাঙালি জাতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি কিংবা আদৌ ছিল না। সেই কারণে বাংলার ইতিহাসে নাম মাত্র উল্লেখ থাকে সেই সাম্রাজ্যের যার চার শত বছরের রাজত্বকালে এই বাংলা শৌর্যে বীর্যে, পরাক্রমে, বিদ্যাবৈভবে, শিক্ষাসংস্কৃতিতে উচ্চতায় শীর্ষ শিকড় স্পর্শ করেছিল। বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ অর্থাৎ পাল আমলের দিকে ফিরে তাকাই।

গৗড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক ছিলেন প্রাচীন বাঙ্গালার গৌড় সাম্রাজ্যের সার্বভৌম নৃপতি ও বাংলা অঞ্চলে একীভূত রাষ্ট্রের প্রথম স্বাধীন রাজা। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্র করে গৌড় জনপদ গড়ে তোলেন। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে তিনি রাজত্ব করেছেন। (১৪) শশাংক পরবর্তী নৈরাজ্যময় মাতসায়ান্নের যুগ। দীর্ঘ অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই যুগ কাটিয়ে পূর্বাকাশে উদিত হয়েছিল সোনালী সূর্য সেই ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে। এই বাংলায় গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল বৌদ্ধদের হাতে। বাংলার জনগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করলেন তাঁদের রাজাকে। এই বাংলায় ঐক্য, সুশাসন ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন গোপাল। আরম্ভ হয় পাল সাম্রাজ্যের সেই স্বর্ণালী ঐতিহ্য, এক নতুন যুগের। পাল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল সম্রাট গোপালকে ঘিরে, যার জন্মজনপদ বর্তমানের গোপালগঞ্জে। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই, ধর্মপাল, মহীপালের হাতধরে চার’শত বছর পরিচালিত হয়েছিল এই দেশ।

এই দেশেই জন্ম নিয়েছিলেন মহাপণ্ডিত শীলভদ্র (জন্ম ৫২৯ মৃত্যু ৬৫৪ খ্রীষ্টাব্দ)। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রাম। ওই গ্রামে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন পণ্ডিত শীলভদ্র নামের এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন সপ্তম শতকের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত ও দার্শনিক । তিনি ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। সে সময় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হতো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে তিনি ২০ বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ও সন্ন্যাসী হিউয়েন সাঙের শিক্ষক ছিলেন।

এই বাংলাদেশে নামক ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত শান্তরক্ষিত, অনাবিষ্কৃত চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহারের আচার্য পণ্ডিত প্রজ্ঞাভদ্র (৭০০৮০০ খ্রীঃ) হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার গৌরব অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানসহ প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মহামনীষী। যাঁদের আলোয় শুধু এইদেশ নয় সারাবিশ্বকে আলোকিত করেছিলেন। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ, বৌদ্ধগান ও দোঁহা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের হাতেই রচিত হয়েছিল। আমাদের লুইপা, কাহ্নুপা, তিলোপা, হাড়িপাসহ প্রমুখ সিদ্ধাচার্যরা এই বাংলাভাষার সূচনা করেছিলেন। বাংলার সূর্যসন্তানরা তাঁদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন যে ভাষার জন্য ঊনিশ’শ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে।

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে অবস্থিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়। ধারণা করা হয় ১১শ শতাব্দীর শেষ দিকে অথবা ১২শ শতাব্দীর প্রথমে এই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম হিসেবে সর্বস্বীকৃত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ শহরে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় যা ১২০৯ সালে প্রতিষ্ঠালাভ করে। এটি ইংরেজিভাষী বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু সেই পশ্চিমাদের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির বিপ্লবের অনেক আগেই এই দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল। সেই বাতিঘরের দীপ্ত আলোকশিখা দেশদেশান্তর পেড়িয়ে সারা বিশ্ব আলোকিত করেছিল।

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধভরত থেকে ভারতবর্ষ অতঃপর হিন্দুস্থান ইন্ডিয়া হয়ে ভারত