মুর্তজা বশীরকে শৈশব থেকেই রং ও রেখা কাছে টানতো। শিল্পীর মনের মধ্যে একটা দোলাচল সবসময় কাজ করতো। নিজের ছবিতে কী তিনি ফুটিয়ে তুলবেন- স্থানকালের বিশিষ্টতা না আন্তর্জাতিক শিল্পধারার আধুনিক উদ্ভাবনের সংলগ্নতা। তিনি দেশীয় রীতিতে ঝুঁকলেও সেখানে স্থিত থাকেননি। শিল্পীমাত্রেরই মনোজগতের রূপ ও রং বদলায়, মুর্তজা বশীরের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে।
মুর্তজা বশীর শুধু চিত্রশিল্পী নন, সাহিত্যের নানা শাখায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি অনেকটা সময় সক্রিয় থেকেছেন। চিত্রকলায় শিল্পী বাস্তববাদী ও সমাজমনষ্ক। আর সাহিত্যে তিনি রোমান্টিক। তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সমাজ বাস্তবতার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ ‘কাঁচের পাখির গান’ (১৯৬৯), উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন (১৯৭৯), কবিতাগ্রন্থ- ‘এসরেণু’ (১৯৭৬), ‘তোমাকেই শুধু’ (১৯৭৯) এবং ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ (১৯৮৫) ও নির্বাচিত রচনা ‘মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত’ (২০০১)।১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে তিনি সমাজ বাস্তবতা ও শিল্পীত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘নদী ও নারী’র সঙ্গে তিনি আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ছিলেন চিত্রনাট্য সংলাপ লেখক, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে। কারওয়াঁ চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তাঁর লেখা। ‘ক্যায়সেকহু’ চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এসবের পূর্বে ১৯৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন চলচ্চিত্রকার ডাব্লিউ. জেড. আহমেদের সহকারী রূপে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন।
মুর্তজা বশীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮০’র দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে সংগ্রহ কমিটির দায়িত্বপালন করতে যেয়ে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণায় আকৃষ্ট হন মুর্তজা বশীর। এখানে ছিলেন দীর্ঘকাল। ১৯৮৯ সালে জার্নাল অর ল্যুমেসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া নামে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর সুলতানী আমলের মুদ্রা সংক্রান্ত ৬টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। হাবশী সুলতানদের বিষয়ে বিশদ কোন প্রকাশনা না থাকায় তিনি এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে লেখেন- যা ২০০৪ সালের ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় মুর্তজা বশীরের জন্ম। তার বাবা ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং মা মরগুবা খাতুন। তাঁর পিতা সময়ের এক অগ্রসর আধুনিক বোধসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও চিত্রশিল্পী পেশার অনিশ্চয়তার ব্যাপারে দোলাচলে ছিলেন। এছাড়া সেই সময় শিল্পী জীবনের ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত ও সংগ্রামমুখর। সেকারণে মুর্তজা বশীরের আর্ট স্কুলে পড়ার ব্যাপারে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কিছুটা বাধা এসেছিল। কিন্তু শেষতক শিল্পের প্রতি পুত্রের গভীর আগ্রহের কারণে সেই দোলাচল কেটে যায়।
১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্প শিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাস করেন। শৈশবে ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, ঠিক শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনা তাঁর ছিলনা। চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির দিক নির্দেশনায়। ১৯৪৭ সালে মুর্তজা যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখনই তিনি আকৃষ্ট হন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অংকনে হাতেখড়ি হয় তাঁর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন ব্যানার শিল্পীদের গ্রাফ করে ছবি আঁকার কৌশল, ঘরে ফিরে করতেন অনুশীলন। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন ১৯৪৮ সালে বগুড়ায় এসে পার্টি অফিসে বশীরের আঁকা ছবি দেখে তাঁর অটোগ্রাফ বইতে লিখেছিলেন-‘আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।’ এই বাণী কিশোর বশীরকে আলোড়িত করেছিল বলেই তিনি হয়েছেন দেশের একজন অন্যতম চিত্রশিল্পী। এদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা নিজেদের প্রগতিবাদীর ধ্বজাধারী মনে করেন তারা ধর্মের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। মুর্তজা বশীর এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি ইসলামী ক্যালিগ্রাফি চর্চা করেছেন। তাঁর মতে, দুশ’ বছর বাংলার স্বাধীন সুলতানরা শাসন করেছিল। এখানকার শিলালিপি, মুদ্রা -এগুলো আমাদের ঐতিহ্য। তিনি ইসলামী ক্যালিগ্রাফি করেছেন বিশ্বাস থেকে। তিনি আনুষ্ঠানিকতায় নয়, মনেপ্রাণে ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বগুড়ায় আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটি মিছিল-সমাবেশের আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ময়মনসিংহের হাজং, মাদ্রাজের তেলেঙ্গেনা ও পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জনযুদ্ধের সমর্থনে ১৯৫০ সালের ৭ জুন ‘মুক্ত এলাকা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়। তিনি ময়মনসিংহের মানচিত্র এঁকে চকবাজারে যান পোস্টারিং করতে। শেষ না করতে পোস্টার ছিঁড়ে যায়। পোস্টার জোড়া লাগাতে গিয়ে পুলিশ আটক করে। ৫ মাস কারাভোগ করতে হলো তাঁকে। জেলে বসে তিনি কবিতা-গল্প লেখা শুরু করেন। পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। তখন চিত্রকলার প্রতি অনেকটা আগ্রহ কমে যায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবদেীনের পরামর্শে আগ্রহ ফিরে পান তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। রক্তাক্ত বরকতকে যারা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন মুর্তজা বশীরও সে দলে ছিলেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাযাতেও অংশ নেন। পুলিশ আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে তারা পলাতক থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন এবং ফেস্টুন এঁকেছেন। তাঁর কার্টুনগুলো দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতালিতে লেখাপড়া করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা সময়ে।
মুর্তজা বশীরের অন্যতম শিল্পকর্ম ‘দেয়াল’। এ সম্পর্কে শিল্পী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন-‘অ্যাস্ট্র্যাক্টে আমি বিশ্বাস করি না। এখনো বিশ্বাস করি না। এ সমাজের প্রতি আমার অনেক কমিটমেন্ট আছে। এর সঙ্গে তো রাজনীতি জড়িত। একটি জিনিস আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, একদিন বিপ্লব বাংলাদেশে হবেই। কারণ বাংলাদেশ মানে হাইরাইজ বিল্ডিং না, কাচে ঘেরা শপিং মল না। আমি মনে হয় একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা করাচি ও ঢাকায় হাসপাতালের মর্গে ডেডবডি তুলে ড্রইং করেছি, শুধু করি নি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াহিদুল হকেরটা। কারণ ও আমার বন্ধু ছিল। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ মানে একটি বেওয়ারিশ লাশ। কেউ মাংস নিয়ে গেছে, কেউ কিডনি নিয়ে গেছে। আমার বন্ধু আমিনুল এবং কিবরিয়া যখন পুরোপুরি অ্যাবস্ট্র্যাক্ট করছে, তখন আমার মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করল। আমার মনে হলো আমি বোধহয় সমকালীন শিল্পচর্চা থেকে পিছিয়ে পড়ছি। কিন্তু ১৯৬৬ সালের দিকে, আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্র শাসনে একটি দমবন্ধ অবস্থা। আমি খেয়াল করলাম, আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে পুত্র-কন্যা-স্বামী-স্ত্রী পরস্পর কমিউনিকেশন করতে পারছে না। আর এটা আমাকে পরিস্কার করেছিল আমার এক বন্ধু। সে একটা মেয়েকে গোপনে বিয়ে করেছিল, তা নিয়ে পরে কোর্ট কাচারি হয়েছে। কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে মেয়েটি চিনতে পারছিল না। আমি দেখলাম যে, সবাই যেন এক অদৃশ্য প্রাচীরের মধ্যে বন্দি। আর এইসব দেখেই আমি ‘দেয়াল’ আঁকার কথা ভাবি। আমি ঢাকার দেয়ালগুলো- বিভিন্ন প্রাচীর, জেলখানার প্রাচীর, যে দেয়ালের ইট বের হয়ে আছে, কোনো বাচ্চা ছেলে হয়তো পেরেক দিয়ে দাগ দিয়েছে, দেয়ালে কেউ হাতের ছাপ দিয়েছে, পোস্টার ছিঁড়ে গেছে- সেগুলো আমি দেখি। মাঝে মাঝে খাতায় টুকেও রাখতাম। তারপর বাসায় এসে সেগুলো আঁকতাম। এরপর আমি সেগুলো পাকিস্তানের সারগোদা ও করাচিতে গিয়ে আঁকলাম। ফ্রান্সের মঁমরাসীতে-এ আঁকলাম, প্যারিসে আঁকলাম।’ (অন্যদিন, ঈদসংখ্যা ২০১৫, পৃষ্ঠা-৩৭২)।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাধারণ মানুষ শহীদ হয়েছেন। কীর্তিমান এই শিল্পী চিন্তা করলেন তাদের কথা কেউ বলবে না। সাধারণ মানুষের কথা বলার জন্য দায়বদ্ধতা অনুভব করলেন শিল্পী। রেনেসাঁ শিল্পীদের বাস্তবতার দৃষ্টি দিয়ে ও ইমপ্রেশানিস্ট শিল্পীদের মন-মানসিকতা দিয়ে ‘শহীদ শিরোনাম’
(এপিটাফ) শিল্প সৃষ্টি করলেন। এস ছবি এবং আশির দশকের কাজগুলো, পাখা সিরিজের ছবিগুলোকে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘মূর্ত বাস্তবতা’ বলে। বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে চিত্রকলার প্রায় সব মাধ্যমে মুন্সীয়ানার ছাপ লক্ষ্যণীয়। গ্রামীণ ও নগর জীবন তাঁর বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে এসেছে। পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। অঙ্কনশৈলীতে রাজনৈতিক বিশ্বাসের দৃঢ়তার প্রমাণ মেলে। তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছেন একুশে পদক (১৯৮০), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯) সহ নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি। বৈশ্বিক মহামারীর কাছে হার মানতে হয়েছে এই মহান শিল্পীকেও।