এ উপমহাদেশে অসাধারণ বেলায়তী শক্তি, দ্বীনী বিষয়াদিতে গভীর ইল্ম বা জ্ঞান, ওই ইল্ম অনুসারে অকৃত্রিম আমল, দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে অস্বাভাবিক আন্তরিকতা, বিশুদ্ধ আক্বাইদ পোষণ, বাতিল আক্বীদাগুলোর মূলোৎপাটনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, দ্বীনের বিশুদ্ধতার সংরক্ষণের জন্য সাচ্চা আলিম তৈরির অব্যর্থ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সমাজের সর্বস্তরে সুন্নিয়াতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ যত আউলিয়া–মাশাইখের এ উপমহাদেশে শুভ পদার্পণ ঘটেছে তাঁদের মধ্যে শাহানশাহ–ই সিরিকোট হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। বিশেষভাবে মুসলমানদের ঈমান–আক্বিদা ও আমলের সংরক্ষণ এবং দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে তাঁর ঐতিহাসিক অবদানগুলোর সুফল ও সুদূর প্রসারী ফলশ্রুতির যথাযথ মূল্যায়ন করতে গেলে আজ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বিশেষত এদেশে শাহানশাহ–ই সিরিকোট হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটির শুভাগমন না ঘটলে হয়তো এ দেশের মুসলিম সমাজে শরীয়ত, ত্বরীক্বত ও সুন্নিয়াতের ইতিহাসে এক দুঃখজনক অধ্যায় রচিত হতো। দ্বীন–ইসলামের মৌলিক নিষ্কলুষ আদর্শ, শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের প্রকৃত শিক্ষা ও দীক্ষার মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের ভালবাসার মজবুত ও অটুট রশিতে গ্রথিত রাখার ক্ষেত্রে যেই বেলায়তী শক্তিসমৃদ্ধ সৎ সাহস, দূরদর্শিতা ও অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার দরকার, তা–ই তিনি যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছেন। এ কারণে আজ মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে সুন্নী–সমাজ আল্লাহ্ ও রসূল এবং এ মহান ওলীর প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। এসব ক্ষেত্রে তিনি এ দেশে চিরদিন এক অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।
শাহানশাহে সিরিকোট শুধু সুন্নী আক্বীদার পূর্ণাঙ্গ ধারকই ছিলেন না বরং তিনি ও তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিদের প্রত্যেকে হলেন সুন্নী আক্বীদার প্রবাদপুরুষ। এমনকি, তাঁদের ‘মুরিদ’ বলতেই খাঁটি সুন্নী আক্বিদাসম্পন্ন– একথা সর্বত্রই সুপ্রসিদ্ধ। শাহানশাহে সিরিকোট ও তাঁর উত্তরসূরি বুযুর্গগণ শুধু দ্বীনী শিক্ষায় সমৃদ্ধই নন বরং উপমহাদেশের অনেক সর্বোচ্চ পর্যায়ের দ্বীনী সুন্নী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিষ্ঠাপূর্ণ–প্রতিষ্ঠাতা এবং পৃষ্ঠপোষকও। তাঁদের ঊর্ধ্বতন শায়খ হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্ ‘ইল্মে লাদুনী’র ধারক। তাঁর রচিত মজমু‘আহ্–ই সালাওয়াত–ই রসূল’ (ত্রিশ পারা সম্বলিত বিরাটাকার দুরূদ শরীফ গ্রন্থ) এর জ্বলন্ত স্বাক্ষর। তাঁদের তাক্বওয়া–পরহেযগারীর পূর্ণাঙ্গতা আজ সর্বজন বিদিত। শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় ত্বরীক্বা–ই ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য। দেশে–বিদেশে শতসহস্র মাদরাসা ও খানক্বাহর অনন্য শোভামণ্ডিত অস্তিত্ব ও কর্মতৎপরতা এ বিষয়কেও মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছে।
প্রকৃত সুন্নিয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা)। এর জন্য তিনি স্থানের বৈশিষ্ট্যাবলীও এভাবে বলেছিলেন– মাদ্রাসাটি এমন জায়গায় হবে যা শহরও নয়, গ্রামও নয়, সেখানে মসজিদও থাকবে, পুকুরও থাকবে। (ওয়হ্ মাদরাসা আয়সী জাগাহ্ মে হোগা, জো শহর ভী না হো, গাঁওভী না হো। ওহাঁ মসজিদ ভী হো, তালাব ভী হো।) জামেয়ার বর্তমানকার মনোরম জায়গাটা যেন তিনি তাঁর বেলায়তী দৃষ্টিতে তখনই দেখে চয়ন করে নিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি ওইসব বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্থান নাযির পাড়ায় এসে ওখানকার ওই জামে মসজিদে বসেই ওই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সূচনা করেছিলেন। ওই প্রথম বৈঠকেই জামেয়া প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেই শাহানশাহে সিরিকোট প্রশান্ত হয়েছিলেন। তখন যাঁরা হুযূর ক্বেবলার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ও এ যুগান্তকারী খিদমতে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হুযূর ক্বেবলাকে খুশী করেছিলেন তাঁরা কতোই ভাগ্যবান! তাঁরই ইচ্ছা, দো‘আ ও কৃপাদৃষ্টির বরকতে আজ ‘জামেয়া’ আপন মহিমায় তার বরকত দ্বারা গোটা সুন্নী দুনিয়া তথা গোটা দেশ, জাতি ও মুসলিম সমাজকে ধন্য করে আসছে।
মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করে তিনি ক্ষান্ত হননি; বরং এর প্রতি তিনি তাঁর বেলায়তী শক্তিসঞ্জাত পৃষ্ঠপোষকতাকেও অব্যাহত রেখেছেন। তিনি জামেয়া সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী ও নসীহত করে গিয়েছেন তা থেকেও একথার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাস্তবতা তো আছেই। তিনি তাঁর সমস্ত মুরীদকে, বিশেষভাবে, জামেয়ার খিদমতের জন্য তাকিদ দিয়ে গেছেন। খিদমতকারীদেরকে উভয় জাহানের শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাফল্যের প্রতিশ্রুতিরূপী সুসংবাদ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে এতে অবহেলা কিংবা এর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের অনিবার্য ক্ষতি সম্পর্কেও সতর্ক করে গেছেন। সর্বোপরি, তাঁর সন্তুষ্টি, ভালোবাসা ও কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার জন্য জামেয়ার প্রতি সর্বাধিক মনযোগ দেওয়া ও যত্নবান হওয়াকে পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন– ‘‘মুঝে দেখনা হ্যায় তো মাদরাসা কো দেখো। মুঝসে মুহাব্বত হ্যায় তো মাদ্রাসা কো মুহাব্বত করো।’’ (আমাকে দেখতে চাইলে মাদ্রাসা কে দেখো, আমাকে ভালোবাসলে মাদরাসাকে ভালোবাসো।)
ইসলামের প্রকৃত আদর্শ (সুন্নী মতাদর্শ)-কে স্থায়ীভাবে অম্লান রাখার জন্য দক্ষ, মুত্তাক্বী–পরহেযগার, মুনাযির, লেখক, ওয়াইয এবং নিষ্ঠাপূর্ণ ওলামা তৈরি করার বিকল্প নেই। তাই শাহানশাহ্ সিরিকোট বিভিন্নভাবে দ্বীনী শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সর্বস্তরের মানুষের ঈমান–আক্বিদা ও আমলের হিফাযতের জন্য এবং আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের নিমিত্তে এ খাঁটি তরীক্বার ব্যাপক প্রসার করেন। শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের খিদমত সমান্তরাল গতিতে পরিচালনার জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি খানক্বাহ্ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এসব প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’র মতো সংস্থা (ট্রাস্ট)।
সর্বোপরি, রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য খলীফা ও উত্তরসূরিদের। বলাবাহুল্য, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে মুর্শিদী সাইয়্যেদী হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ আনজুমানের উন্নয়নকে অব্যাহত রাখেন। জামেয়ার সার্বিক উন্নতি সাধন করেছেন। শাহানশাহে সিরিকোট হলেন নায়েবে গাউসুল ওয়ারা, ইলমে লাদুনীর ধারক, উলূমে ইলাহিয়্যার প্রস্রবণ হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমার সুযোগ্য খলিফা। দীর্ঘ আঠার বছর যাবৎ তিনি আপন মুর্শিদে বরহক্ব হযরত চৌহরভীর সান্নিধ্যে র’য়ে এবং তাঁর মাদরাসা (মাদরাসা–ই রহমানিয়া, হরিপুর)-এর খিদমত ও পরবর্তীতে পৃষ্ঠপোষকতা করে বেলায়তের উচ্চাসনে আসীন হয়েছেন। তারপর আপন মুর্শিদের নির্দেশে সুদূর বার্মায় গিয়ে দীর্ঘদিন দ্বীন, মাযহাব ও তরিক্বতের অনন্য খিদমত আন্জাম দেন। এ সফরের ফলে সুদূর বার্মায় যেমন অগণিত বার্মাবাসী এ মহান ওলীর সান্নিধ্য ও এ মহান বরকতমণ্ডিত তরীক্বতে সামিল হবার সুযোগ পান। তেমনি তখনকার সময়ের অনেক বার্মা প্রবাসী বাংলাদেশীও শাহানশাহে সিরিকোটের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হন। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হবার পূর্বেই অগণিত মানুষ শাহানশাহে সিরিকোটের নূরানী পরামর্শক্রমে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর এদেশের মানুষ শাহানশাহে সিরিকোটের পদধূলিত অকল্পনীয়ভাবে ধন্য হয়েছে; সুগম হয়েছে সর্বস্তরে সুন্নিয়াত প্রতিষ্ঠার পথ। ইতোপূর্বে শাহানশাহে সিরিকোট আফ্রিকা সফর করেছেন এবং সেখানেও শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের প্রসারে বহু ঐতিহাসিক অবদান রাখেন। ১৩৮০ হিজরি/১৯৬১ খ্রি. ১১ যিলক্বদ হুজুর সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ওফাত বরণ করেন। ১১ যিলক্বদ ১৪৪৬হি. মোতাবিক ১০ মে ২০২৫ এ মহান ওলীর ৬৬তম ওরশ মোবারক তাঁর নূরানী হাতে প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। তাঁর রূহানী ফুয়ুযাত আমাদের নসীব করুন। আমিন।
লেখক
মহাপরিচালক–আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, ষোলশহর, চট্টগ্রাম