পত্রিকার পাতা উল্টালেই নিত্যদিন চোখে পড়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য খুনোখুনি, ছোট্ট শিশু হত্যা, আত্মীয় আত্মীয়কে জমির জন্য গলায় ছুরি চালানো, কোনো তরুণী তার বিশ্বস্ত প্রেমিক কর্তৃক ধর্ষিতা হওয়া, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা হয়ে নিজে নিজে আত্মহনণের পথ বেছে নেয়া, কোনো অসহায় বৃদ্ধপিতা ঘরের এককোণে মরে পরে থাকা কিংবা কোনো মা তার ছোট্ট শিশুর জন্য খাবার জোগাড় করতে না পেরে মৃত্যুর পথযাত্রী হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এতোসব নেতিবাচক খবরের ভীড়ে কখনও কখনও হয়তোবা ইতিবাচক কিছু খবরও চোখে পড়ে তাও একেবারে পত্রিকার এককোণে। দূর অতীতে বাঙালি সমাজে যে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালাভরা গরু, বিঘায়বিঘায় ধানিজমি তা আজ তেমন একটা চোখে পড়ে না। সেসময় বাঙালি সমাজ ছিল একান্নবর্তী পরিবারের আওতাভূক্ত, সুখ বলতে এখানে সকলের সুখকে বোঝাতো আর দুঃখ বলতে সবাই একসাথে দুঃখের ভাগীদার হতো। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সবাই হেসে খেলে জীবন কাটাতো।
যে বাঙালি সমাজে একসময় একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যেই খুঁজে পেতো নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে, হাসি, কান্না আর প্রত্যাহিক জীবন চলার অনুপ্রেরণা আজ সেই একান্নবর্তী পরিবার প্রায় নেই বললে চলে, ফলে পরিবারের একজনের সাথে অন্যজনের হাসি, কান্না দুঃখ ভাগাভাগি করার মতো কেউ নেই, কেবল যন্ত্রের মতো অর্থের জন্য বিরামহীনভাবে ছুটে চলা।
আদিম পরিবার ব্যবস্থা ভাঙতে ভাঙতে আধুনিক জীবনাচারে এখন পরিবারের ধারণাটাই অনেকের কাছে পাল্টে গেছে। একসময়ে বাবা-মা, দাদা-দাদু, কাকা-কাকী, জেঠা-জেঠিদের নিয়ে এমন একটি বিশাল পরিবারকে এখন আর চোখে পড়ে না। এখন পরিবার বলতে টোনাটুনির সংসারকে বোঝায়, এমন পরিবারে সর্বোচ্চ চারজন মানুষকে দেখা যায় অথচ এমন ছোট্ট পরিবারে একজন শিশু তার প্রাথমিক জীবনে জীবনবোধের সমগ্র শিক্ষা নিয়ে বড় হতে কী পরিমাণ যে কষ্ট হয় তা অনেকেই বোঝে না। অনেকেই হয়তো বলবেন এই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণটা অনেকটাই দায়ী। কিন্তু বর্তমানে অর্থ যাদের অঢেল তারাও একান্নবর্তী পরিবারকে টিকিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করছেনা তারাও তো সেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর পরিবারেই আবদ্ধ থাকতে চাইছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সমাজ কেনোইবা এতো অসহিষ্ণু হয়ে ওঠলো আর কেনোইবা সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে আজ শঠতা, কপটতা বাসা বেঁধে একেবারে স্থায়ীভাবে বসত করতে শুরু করলো।
প্রকৃতপক্ষে দূর অতীতে নানা, দাদীদের মতো কেউ আর তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেয় না। বলেনা বড়দের দেখলে সালাম পেশ করবে, যথানিয়মে ধর্মশালায় গমণ করবে, চুরি করবে না, চুরি করা মহাপাপ, কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করবেনা সারাদিনে কমপক্ষে একটা হলেও ভালো কাজ করবে হোক সেটা অনেক ছোট, বিষয়গুলো বর্তমান যুগের জন্য একেবারে নস্যি হলেও এসব কথা তার প্রথম জীবনে তার বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট থেকে প্রতিদিন শুনতে শুনতে তার মনে এই ধারনা বদ্ধমূল হয় যে, কোনো অন্যায় কাজ করা যাবে না আমার দাদা কিংবা দাদী আমাকে বলেছে। মূলতঃ মানবিক শিক্ষাগুলো পরিবার কিংবা সমাজ থেকে ছোট বয়স থেকে শিখে নিতে হয়, এধরণের মানবিক শিক্ষা যে পরিবার তার পরবর্তী প্রজন্ম যতোবেশি দিতে পারবে তাদের পরিবারের সদস্যরা ততোবেশি মানবিক মানুষ হয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারবে।
এধরনের মানবিক শিক্ষা প্রতিটি সমাজে বিদ্যমান থাকলে সমাজ কখনও অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে না ফলে সমাজ সুস্থ ধারায় এগিয়ে যাবে। তাই আসুন সবাই পরিবার থেকেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মানবিকতার শিক্ষা দেই, একটি সুস্থ এবং সুন্দর সমাজ গঠনে সমাজের সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক











