অসম্ভবের সাথে লড়াই : ওসমান গনি মনসুরের করুণ সাহিত্য-সৌধ

আবু মুসা চৌধুরী | বুধবার , ১১ মে, ২০২২ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

এ এক অসম লড়াই। অনমনীয় সংগ্রাম। প্রকৃতি বা নিয়তির সঙ্গে মানুষের চিরন্তন বৈরী সম্পর্কের আর একটি অ্যাপিসোড। প্রতিপক্ষ এখানে ফুলের মতো এক দেবশিশুর সঙ্গে কালান্তক ব্যাধি কর্কট রোগের।

ফুটফুটে শিশুটি মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান। নয়নের পুত্তুলি। স্বজন-পরিজন, চেনা-জানা এবং বন্ধুদের বড়োই প্রিয়। সকলের পছন্দের। নাম-রাফি। এই পৃথিবীর জল-হাওয়া-মৃত্তিকায় সকলের ভালোবাসার ছায়ায় মাত্র চার হাজার চারশ চুরানব্বই দিন কাটিয়ে, সকলকে কাঁদিয়ে, ঘাতক-ব্যাধি লিউকোমিয়ায় মরণপণ যুদ্ধ করে, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমায় মেধাবী বালকটি।

করাল ক্যানসারের বিরুদ্ধে ইরফানুল গনি রাফি ও তার বাবা-মা এবং আত্মীয়কুল এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের যে ১১ মাসের প্রাণান্তক মহাসমর, এরই বিশ্বস্ত বয়ান-ওসমান গনি মনসুর রচিত-‘অসম্ভবের সাথে লড়াই’।

যদিও দিনলিপির আঙ্গিকে লেখা এই মর্মন্তুদ শব্দাবলি, তবুও তা নিছক ব্যক্তিক ভাষ্য না হয়ে, এক সাহিত্যকর্মে পর্যবসিত লেখকের সাধু গদ্য ও সংবেদনশীল অনুপুঙ্খ বর্ণনা-সর্বোপরি আবেগায়িত ভাষাশৈলী, এই গ্রন্থে একটি ট্রাজিক উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় পাঠকের।

‘লাইফ ইজ স্ট্র্যাঞ্জার দ্যান ফিকশন’-জীবন গল্পের চেয়ে বিস্ময়কর; এই আপ্তবাক্যের নিরিখে এই সাহিত্যকর্মে দৃকপাত করলে, দৃষ্ট হয়-অ্যনা ফ্রাঞ্চের ডায়েরি, কিংবা অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, নয়তো আমরা বিবেচনায় আনতে পারি বিশ্ববরেণ্য ওরিয়ানা ফ্যালাসির একটি অনাগত শিশুর জন্মকাহিনি ‘হাত বাড়িয়ে দাও’-এর সাথে। এসব রচনায় ফ্যাক্ট ও ফিকশন সর্বার্থেই একাকার। প্রথিতযশা সাংবাদিক ওসমান গনি মনসুর আত্মজবানিতে এই হৃদয়স্পর্শী উপন্যাস নির্মাণ করেছেন।

রাফির রোগ ধরা পড়ার পর, শুরু হয়ে যায় এক মৃত্যুঞ্জয়ী যুদ্ধ। স্বয়ং রাফি এবং ওর বাবা-মাসহ চিকিৎসাপ্রযুক্তির বিরুদ্ধে হন্তারক কর্কট ব্যাধির এই অক্লান্ত যুদ্ধের ক্ষেত্র ছিলো বাংলাদেশ, মুম্বাই, সিঙ্গাপুর। ক্ষণে ক্ষণে তৈরি হয় সাসপেন্স, ক্লাইমেক্স। মৃত্যু যেন ঝুলে থাকে এক চুল দূরে। আবার জীবনের সলতেটাও জ্বলে জ্বলে ওঠে আচম্বিতে। এই দোলাচলের চূড়ান্ত পর্বে রাফির প্রার্থনা: “আমি তো ছোট মানুষ, আমি তো কোনো পাপ করিনি।” আমার এত কষ্ট কেন ?
কিন্তু ডাক্তাররা সবাই মিলে বুঝলেন রাফির কষ্ট দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। রাফি ওর দাদি ও ‘বনানী মাসির কথা জানতে চায়। ফোনে বলে, বনানী মাসি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, বুক ব্যথা, দোয়া করবেন। ’

অতঃপর এলো সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত। লেখকের বর্ণনা: আমার স্ত্রী এসে বললো, রাফি আমাকে ডাকছে। আমি ছুটে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম। বাম হাতের কবজি আইভিতে ইনজেকশান চলছে। ডান হাতে আমার এক হাত বুকে ধরে রেখেছে।… হঠাৎ হঠাৎ তার আধামুষ্টি হাতটা ঝটিকার মতো খুলে গেলো। মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারলাম রাফি আর নেই। এই পৃথিবীর আলো তার চোখে লাগছে না। বাতাস আর শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে আসছে না। কারো ছোঁয়ায় তার সাড়া জাগবে না।
মৃত্যুর এই হিমশীতল-শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা পাঠের পর যে কোনো পাঠকের চোখের পাতা ভিজে যাবে অবশ্যই। রাফি নামের এক রূপবান বালক, পৃথিবীর প্রতি যার মমতা অপরিসীম, তার জন্য ভালোবাসায়, দরদে, মৃত্যুর এই নিঠুর স্পর্শে বুক ভেঙে যায়। রাফির ভাগ্যাহত পিতার জবানি: রাফির সংক্ষিপ্ত জীবনের কিছু বর্ণময় খণ্ডচিত্র আমাদের নাড়া দেয়। হয়তো আপনাদেরও আন্দোলিত করবে। স্মৃতিময় ঘটনাসমূহের মধ্যে তার গুপ্ত জীবনাবেগ আপনারা প্রত্যক্ষ করবেন। তার সম্ভাবনাময় অসম্পূর্ণ জীবনের জন্যে তার কথা ভেবে হয়তো দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরবে। হয়তো অলক্ষ্যে থেকে সে জানবে তার জন্য কেউ দোয়া করছে।

আলোচ্য গ্রন্থের গ্রন্থকারের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব, তিনি স্পর্শ করতে পেরেছেন। কাঁদাতে পেরেছেন-এ এক বিরল ও বিরাট কৃতিত্ব।

মুখবন্ধে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল আহাদ যথার্থই বলেছেন: প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি বাক্যের ভিতর ওসমান গনি মনসুরের চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রুর বন্যা এবং তার সাথে একাত্ম হয়ে আমারও চোখ ভিজে গিয়েছিল, আমিও সেই অশ্রুর বন্যায় তার সহযাত্রী হয়েছি।

পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। সুলেখক ওসমান গনি মনসুর সেই হিমালয়-সম ভারী-বোঝা বহন করেছেন স্কন্ধে। তারপর সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-যন্ত্রণা-হাহাকার মাড়িয়ে সৃজন করেছেন এই করুণ সাহিত্য-সৌধ। এই অনবদ্য ট্রাজেডি। একমাত্র পুত্রকে বাঁচানোর জন্যে তার যে সর্বাত্মক লড়াই-অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে যা জয় করার প্রয়াস; তা ছিলো প্রকৃতি বা নিয়তির বিরুদ্ধে মানুষের প্রবৃত্তি। কিন্তু এটাই সত্য যে, ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়ড্‌ নট ডিফিটেড-মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনো পরাজিত নয়। এ কারণেই রাফির চির-শোকার্ত জননী ডা. রওনক জাহানের উপলব্ধি বা আর্তি-এই পুস্তক মরণঘাতী রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস। গ্রন্থটির নান্দনিক ও অপূর্ব শিল্পসম্মত প্রচ্ছদ করেছেন প্রচ্ছদবিদ ধ্রুুব-এষ। ‘অসম্ভবের সাথে লড়াই’-এর প্রকাশক : বলাকা প্রকাশন, চট্টগ্রাম। মূল্য: ২০০ টাকা।

লেখক : কবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্পর্ক আসলে কী?
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে