একটি আঞ্চলিক পত্রিকা কতটুকু জনপ্রিয় হলে তা বহু প্রথম সারির জাতীয় পত্রিকাকেও ডিঙিয়ে যায় তার প্রমাণ চট্টগ্রামের জনপ্রিয় দৈনিক আজাদী পত্রিকা। চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান প্রকৌশলী রাউজান সূলতানপুর গ্রামের কৃতিপুরুষ বুজর্গ সমাজসেবক মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ও দৈনিক আজাদী আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, আজাদীর আন্দোলন ও ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আজ এখানে আলোচনা করবো অগণন ক্ষুদে লেখক প্রতিভা আবিষ্কারের সূতিকাগার দৈনিক আজাদীর শিশু কিশোর পাতা ‘আগামীদের আসর’ নিয়ে। আগামীদের আসর আমার লেখালেখি জীবনের শুরুতে কী যে প্রেরণা যুগিয়েছিল তা আজ আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। স্কুল জীবনে মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি হাইস্কুলে ‘স্কাউট বুলেটিন’ নামক দেয়ালিকা দিয়ে আমার লেখালেখি শুরু। তারপর ছোট ছোট ছড়া, স্কাউট আন্দোলনের জনক লর্ড বেডেন পাওয়ালের ছোট্ট জীবনী ছাপিয়ে আমাকে ক্ষুদে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসর। পুরো সপ্তাহ বসে থাকতাম আগামীদের আসর প্রকাশের দিনটির জন্যে।
জাতীয় সম্মাননা বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক বন্ধুবর কবি রাশেদ রউফ, কবি খালেদ হামিদীর মতো শক্তিমান বহু লেখকের উত্থান এখান থেকেই শুরু হয়। ‘আগামীদের আসর’– এ আমি কৈশোরের একেবারে স্কুল জীবন থেকে ছড়া কবিতা গল্প লিখার স্মৃতি আজো দেদীপ্যমান। শিক্ষার্থীদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে। একটা লিখা ছাপালেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। আমাদের সময় পরিচালক ছিলেন আমার নানার বাড়ি রাউজানের আরেক কৃতি সন্তান মরহুম সাংবাদিক আতাউল হাকিম। আমাদের কাছে তিনি ‘ভাইয়া’ নামেই পরিচিত ছিলেন। টুকটাক ভুলভ্রান্তি এডিট করে ছাপাতেন। এতে উৎসাহ আরো বেড়ে যেতো। আসরের সদস্য কার্ডটি আজো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। মরহুম আব্বাজান এডভোকেট আলহাজ্ব আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা‘র সমবায় আন্দোলনের সাথী আজাদী সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ আংকেল, তখনকার চবি প্রফেসর (আজকের নোবেলজয়ী) ড. ইউনূস আংকেল, ক্যাপ্টেন (অব🙂 কাসেম, মনতোষ বড়ুয়া, আনোয়ারুল আজীম (ভোলা মিয়া), গৌরশংকর পাল, সমবায় নেতা আহমেদুর রহমান, সাবেক সচিব মাহাবুব আলম চাষী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবেরঅন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক ফজলুর রহমান প্রমুখ সহ আরও কতো সমবায় আন্দোলনের সৈনিকদের তথা স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার কারিগরদের আড্ডা ছিল আমাদের আন্দর কিল্লার বাসা। শৈশবে এসব মহা মনীষীদের সান্নিধ্য আমাকে গৌরবান্বিত করেছে, আলহামদুলিল্লাহ। সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম আগামীদের আসর এর সদস্য কার্ডটি পেয়ে। আমার ক্রমিক নম্বর ছিলো ৩৬১৬। মরহুম আতাউল হাকিম আর আজাদী পরিবারের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা নিরন্তর বহমান। আগামীদের আসর পরিচালনার দায়িত্ব অনেকেই পালন করেছেন, স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতা এর রূপকার ছিলেন। আমাদের সাথে মরহুম আতাউল হাকিম ভাইয়ার স্মৃতি সবচেয়ে বেশি।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সাবেক সভাপতি, প্রবীণ সাংবাদিক আতাউল হাকিম গুরুতর অসুস্থ হয়ে হঠাৎ বিদায় নেন আমাদের মাঝ থেকে। যেখানেই দেখতেন হাসি মুখে কথা বলতেন।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা যায়, তিনি অস্থিমজ্জার ক্যানসারে আক্রান্ত। ৩০ জুলাই মংগলবার রাত নয়টায় ২০১৯ সালে মাত্র ৬৯ বৎসর বয়সে স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা ও অগণিত গুণগ্রাহী রেখে এ মহান ব্যক্তিটি পরপারে পাড়ি জমান। আল্লাহ পাক তাঁকে মেহেরবানি করে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন আমিন। রম্য লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। তার প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে-‘একান্ত ব্যক্তিগত’, ‘অমাবস্যা চতুর্দিক’, ‘নিজগুলো ক্ষমা করবেন’, ‘বিশ্ব পুরুষ সম্মেলন’ ইত্যাদি। আতাউল হাকিম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক আজাদী এবং বহুল প্রচারিত দৈনিক পূর্বকোণে দীর্ঘ ৩২ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর মতো সদাহাস্যজ্বল মিষ্টিভাষী লেখক ও শিশু কিশোর সংগঠক খুব কম দেখেছি। আজাদীর আগামীদের আসর থেকে সৃষ্টি হয়েছিল অগনিত লেখক, গবেষক ও চিন্তাবিদের। সাংবাদিক আতাউল হাকিম ভাইয়া বেশ ক বছর আগে আমাদের ছেড়ে মহান প্রভূ দয়াময় মালিক রাব্বুল আলামিন রহম রহীম এর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতা বিস্তৃত হয়ে আছে আগামীদের আসরের হাজার হাজার লেখক ও দৈনিক আজাদীর লক্ষ লক্ষ পাঠকদের মাঝে।
যাঁরা পুরনো লেখক এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের উপস্থিতিতে ‘আগামীদের আসর’–এর একটি মিলনমেলার আয়োজনের ব্যবস্থা করেছেন আজাদীর মাননীয় সম্পাদক ও পরিচালনা সম্পাদক মহোদয়। এতে আনন্দিত হলাম।
দৈনিক আজাদী ও আগামীদের আসর জিও জনম জনম।
লেখক: আইনজীবী; সদস্য, আগামীদের আসর, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম এবং রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত প্রাক্তন স্কাউট লিডার।