অলৌকিক শক্তি!

প্রফেসর মু. সিকান্দার খান | সোমবার , ১ মার্চ, ২০২১ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল যখন মানুষ সবকিছুতে অদৃশ্য শক্তির কাছে কোন ভাল কাজের সাফল্যের জন্য ধর্না দিত। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ আমরা দিনে দিনে সেদিক থেকে বিমুখ হয়েছি। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখনও কোন শুভ কাজ আরম্ভ করার আগে তার সাফল্য কামনায় অবশ্যই কোন না কোন ভাল মানুষের কাছে বা পবিত্র জায়গায় গিয়ে সাফল্যের জন্য আকুতি জানানোটা সাধারণ্যে প্রচলিত ছিল। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় শৈশবে পরীক্ষার মৌসুমটা ছিল এরকম মনস্কামনা পূরণের জন্য পুণ্য কুড়াবার অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্ব। পরীক্ষার আগে আগে বাড়ির কাছের সব দরগা একবার জেয়ারত করা চাই। উদ্দেশ্য পরীক্ষায় উচ্চতম সাফল্য লাভ। কখনও একা একা, কখনও দলবদ্ধ হয়ে, এ কাজটি সমাধা করেছি। যে যত বেশি পুণ্যস্থান দর্শন করে, যত বেশি পুণ্যাত্মার কাছে আবেদন নিবেদন করতে পারে, তার ফল তত বেশি ভাল হবে এটিই আশা করতাম।
গ্রাম পার হয়ে শহরের স্কুলে পড়ার সময়ও এ বিষয়ে মনোভাব একই থেকে যেত। চট্টগ্রামে প্রায় স্কুলে বছরে দুটো পরীক্ষা নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রথমটি ষাণ্‌মাসিক, দ্বিতীয়টি বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার গুরুত্ব অনুসারে পুণ্যস্থান নির্বাচন করতাম। আমার স্কুল সরকারি মুসলিম হাই স্কুল। পারিবারিকভাবে চট্টগ্রাম শহরের এই স্কুলই আমাদের প্রথম নির্বাচন। সেবার একই স্কুলে আমার এক মামাত ভাই আমার নিচের ক্লাসের ছাত্র। আমি পড়ছি অষ্টম শ্রেণীতে আর সে ভর্তি হয়েছিল সপ্তম শ্রেণীতে। বার্ষিক পরীক্ষার আগেই শহরের সব দরগা জেয়ারত করা হয়ে গেছে। আমাদের বাসা (চন্দনপুরা) থেকে স্কুলে (কোর্টবিল্ডিংয়ের নিকট) যাওয়ার পথে লালদীঘির পূর্ব পাড়ে হজরত শাহ আমানতের দরগা। জানা যায়, চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ দরগাহের মধ্যে এটিই একমাত্র সমাধিস্থল যেখানে এই বুজুর্গের দাফন সম্পন্ন হয়েছিল অর্থাৎ তিনি এখানেই অবস্থান করেন। অন্যরা কেউ চট্টগ্রামে এসেছিলেন (বদর শাহ) কেউ বা এখানে আসন নিয়ে (বায়েজিদ বোস্তামী) এবাদত বন্দেগী করে গেছেন। তাঁদের সশরীরে বর্তমানে কথিত সমাধিস্থলগুলোতে তাঁরা অবস্থান করেন না। তাই শাহ আমানত শাহের জনপ্রিয়তা এখানে বেশি। আর এটি আমার স্কুলে যাতায়াতের পথের মধ্যেখানে পড়ে। এমন বড় কামেল ফকিরের দোয়া নিয়ে পরীক্ষার হলে যেতে পারব, ভাবতে পারিনি, ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাই।
সেবার ষাণ্‌মাসিক পরীক্ষার শেষ দিনে আমাদের ক্লাসিঙের (ধ্রুপদী) পরীক্ষা। আমার নির্বাচিত ক্লাসিক্স উর্দু আর আমার মামাতো ভাইয়ের আরবী। চন্দনপুরা বাসা থেকে আমরা হাতে সময় নিয়ে বার হয়েছি, দরগার জন্য আধঘণ্টা। দরগার মুখে অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বড় জটলা দেখলাম। কাছে পৌঁছে শুনলাম দরগায় এসেছেন উরকিরচরের (আনোয়ারা) ফকির মামা। উরকিরচর আমার মামার বাড়ি, আনোয়ারের নানা বাড়ি। সে মামার কথা শুনে দারুণ আনন্দিত হয়ে উঠল। আমাকে বলল, আজ আমাদের পরম সৌভাগ্যের দিন। পরীক্ষার জন্য মামার দোয়া চাওয়া যাবে।
দরগার উঠানে গিয়ে দেখলাম খালি গা হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা একজন বেশ বড়সর মানুষকে ঘিরে শ’খানেক মানুষের একটা জটলা। আমরা অনেক কষ্টে জটলার মধ্যে ঢুকে মামার একেবারে কাছে পৌঁছালাম। আনোয়ার চিৎকার করে মামার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, “মামা, আমাদের পরীক্ষা, আমাদের পরীক্ষা।” পরীক্ষার কথা শুনে এবং আমাদের ক্ষুদ্রাকৃতি দেখে জটলার মানুষরা আমাদের বেশ খানিক জায়গা করে দিল। আমরা সহজ হয়ে দাঁড়ালাম। মামার কোঁচর ভর্তি মুড়ি। সবাইকে মুঠো মুঠো দিচ্ছেন আর অনবরত বিড় বিড় করছেন। আমাদের দিকে ফিরে মুড়ি দিতে দিতে স্পষ্ট করে বললেন, “বই চুরি ন’ করিস, বই চুরি ন’ করিস”। অন্যদের কি বলেছেন বুঝিনি। কিন্তু, যতবার আমাদের দিকে ঘুরে মুড়ি দিলেন ততবারই ঐ এককথা, “বই চুরি ন’ করিস, বই চুরি ন’ করিস”। আমার জীবনে প্রথম কাউকে শুনলাম আমাকে চুরি থেকে ফেরাবার জন্য কথা বলছেন! কোথায় পরীক্ষা ভাল হবে বলতে বলতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন, সে জায়গায় একি উপদেশ দিচ্ছেন! জীবনে, ঐটুক জীবনে, এরকম অভিজ্ঞতা হবে ভাবতে আমার ভীষণ অপমান লাগছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল মামার দিকে হাতের মুড়ি ছুঁড়ে দিয়ে পালাই আমি। দরগা থেকে কিভাবে বার হয়েছিলাম মনে নাই।
যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছালাম। আমাদের পরীক্ষার সিট পড়েছে দু’তলায়। পর্তুগীজ বিল্ডিং। হেডস্যারের অফিসের পাশের অর্ধচন্দ্রাকৃতির বড় এক লম্বা কামড়া। কামড়াজুড়ে লাগোয়া খোলা বারান্দা। আনোয়ারের সিট পেছনে, আর আমার সিট হয়েছে একেবারে সামনের দিকে। কক্ষের বক্রাকৃতির জন্য পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। যথাসময়ে পরীক্ষার ঘণ্টা বাজল। প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর পরীক্ষায় মনোনিবেশ করলাম। ষাণ্‌মাসিক পরীক্ষা, প্রস্তুতি ভাল ছিল। চুটিয়ে লিখে চলেছি। কখন দু’ঘন্টা শেষের ঘণ্টা বেজেছে। খাতা থেকে মাথা তুলে বাইরের দিকে তাকিয়েছি। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম হেডস্যারের কামড়া থেকে পিয়ন হাত ধরে আনোয়ারকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। নীচে নামার পুরনো দিনের কাঠের সিঁড়ি। চারিদিক নিস্তব্ধ। এ দু’জনের নামার শব্দ টক টক করে আমার কানে নয়, যেন বুকে বাজছে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পরীক্ষার শেষ ঘণ্টার আগে আনোয়ার নেমে যাচ্ছে কেন? অনেক চেষ্টা করে নিজের পরীক্ষায় মনোযোগ দিলাম। তিন ঘণ্টার পরীক্ষা শেষ করে স্কুলের উঠানে নেমে দেখি আনোয়ার এককোণায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কান্নার রেশ তখনও লেগে আছে।
বাসায় ফিরেছি। এক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থা। সেদিন ছিল পরীক্ষার শেষ দিন। তাই অনেকটাই নির্ভার। দুজনের কথা হল। আনোয়ারের সিট ছিল একেবারে শেষের সারিতে। শুনলাম সেখানে হাইবেঞ্চের উপর ছাত্রদের যারা পড়তে পড়তে হলে বই নিয়ে ঢুকে তাদের বই রাখা ছিল। ক্লাসিক্সের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে লিঙ্গান্তর করবার একটা প্রশ্ন থাকে। এই প্রশ্নের উত্তর সঠিক হলে পুরো নম্বর পাওয়া যায়। আর তা না হলে শূন্য দেওয়া হয়। এবারের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দু’একটা লিঙ্গান্তরের প্রশ্ন নিয়ে তার একটু দ্বিধা হচ্ছিল। কর্তব্যরত শিক্ষক সামনের দিকে রাউন্ড দিতে গেলে আনোয়ার সুযোগ বুঝে পাশের টেবিলের উপরের একটা ব্যাকরণ বই সামান্য খুলে দেখার চেষ্টা করেছিল! দুর্ভাগ্যবশতঃ তখনই সেই শিক্ষকের নজরে পড়ে যায়। ষাণ্‌মাসিক বা বার্ষিক কোন ব্যাপার নয়। শহরের সরকারি স্কুলে তখন সর্বোচ্চ কড়াকড়ি পালন করা হত সব পরীক্ষায়। আনোয়ার বই ছুঁয়েছে এই অবস্থায় দেখে পরিদর্শক হেডস্যারের কাছে তাকে নিয়ে গেছেন। শাস্তি যা প্রাপ্য তাই হয়েছে। সব শুনে মনে পড়ে গেল উরকিরচরের মামা স্পষ্ট উচ্চারণে বলছিলেন, “বই চুরি ন’ করিস, বই চুরি ন’ করিস”!
আধ্যাত্মিকতা অনেক উচ্চমার্গের বিষয়। সেখানে পৌঁছার চেষ্টা কাউকে করতেও দেখিনি। কিন্তু, অলৌকিক শক্তিকে একেবারেই অবাস্তব ভাবার সাহসই বা পাই কী করে?
লেখক : উপাচার্য, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে গুড়িয়ে দেয়া ইটভাটা ফের চালু