কবিতা এমন আজব এক শিল্প যা গিলে খায় কোবিদদের যাবতীয় চিন্তাক্রিয়া। কবিতার সর্বগ্রাসী সুন্দরের ছায়ায় শিল্পের অন্যান্য শাখায় বিচরণ কঠিন না শুধু প্রায় দুষ্কর। তাই বলে থেমে নেই বিশুদ্ধমনের শ্রম ও মেধানিষ্ঠ সৃজনক্রিয়া। কবিতা আর প্রবন্ধযাত্রা সমানতালে চলতে দেখে আমাদের বিস্ময় জাগে, প্রশ্নের উদ্রক হয়। ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণি’,- বলতে ইচ্ছে হয় জনারণ্যে। আশ্চর্যের বিষয়, হাফিজ রশিদ খানের কবিতা যেমন বিপুল বিষয়ে নজরানা দেয় তেমনি প্রবন্ধেও থাকে মনন ও সৃজনের দৃশ্যরেখা। এই মেলবন্ধন কিভাবে সমন্বয় করেন? কিভাবে তিনি চিন্তাকে শব্দের সমান্তরালে প্রতিস্থাপন করেন শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে? সমান তালে গদ্য–গবেষণা–সম্পাদনা–নাটক ও কবিতার ভূগোলে সদাসক্রিয় এক তাগড়া যুবক হাফিজ রশিদ খান। কবিতায় এমন নিবিড়ভাবে আর কে এনেছেন আদিবাসীদের জীবন? কে এমন দেখিয়েছেন বিশ্লেষণ ও মননসত্তা প্রবন্ধের দীর্ঘ পরিসরে? তাই তো ভালোবেসে গবেষকেরা তাঁকে দিয়েছেন ‘আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকারের’ তকোমা। উপমা সম্পাদক মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন যেমন বলেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে, হাফিজ রশিদ খান প্রকৃত পক্ষেই গুণী একজন। আকাশের মতো উদার ও উজ্জ্বল তাঁর মন ও মনন। কুরসিকে কখনো করেনি কুর্নিশ কলম তাঁর। এমন মানুষ এ জামানায় পাওয়া ভার। ছোটকাগজেই ছাপা হয় বেশি এই বড় লেখকের লেখা। চিৎকার চেঁচামেচিতে এই চিন্তা নায়ককে কখনো দেখা যায় না। আমাদের চারপাশের অনেকেই যখন চিন্তা ও চরিত্রে হয়ে যাচ্ছেন খর্ব, তখন তার বিপরীতে হাফিজ রশিদ খানের মতো মানুষেরাই আমাদের গর্ব। তিনি বুঝতে পারেন ভালোবাসার মর্ম। পরমতসহিষ্ণুতা তাঁর ধর্ম। তিনি মানুষ নন কোনো দলের। তিনি মানুষ দারাজ দিলের।’ চারদিকে অসৎদের ছিনালিপনার ভেতর এ–এক মুক্তমনার জীবন– ক্ষোভ কিংবা জিঘাংসা নেই, আছে কেবল সৃজনমুগ্ধতা; তারুণ্যের প্রতি অবিচল ভালোবাসা।
তিনি নিজে সাহিত্য বলতে কী বোঝেন? তাঁরই প্রবন্ধের সূত্রে বলা যায়, ‘এক অর্থে ভাষা ব্যাপারটা তো নির্বাক। কালো অক্ষরমালার বধির মিছিল। নিস্পন্দ ভূমা ও ভূমির অন্তহীন ধারণামাত্র। তাকে নাড়ায়, গড়িয়ে নিয়ে যায়, কথা কওয়ায়, যথাযোগ্য কর্ষণে কাজে লাগায় সাহিত্য।’ ভাষাকে সত্যিকার অর্থেই যারা দিতে পারেন প্রাণ তাদের অগ্রগণ্য এক পথিক হাফিজ রশিদ খান। পাহাড়ে শিক্ষকতার সূত্রে তিনি দরদ দিয়ে চিনে নেন পাহাড়ের মানচিত্র ও জনজীবন। পরবর্তীতে দরদকে দায়ে রূপান্তর করে তিনি হয়ে ওঠেন ‘আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার’। পাহাড় এবং সমতলের যে বোধি– উভয় রকম জীবনের এক অনন্য সূত্রধর তিনি। বলা চলে, পাহাড়ের জীবনকে বাংলা কবিতার চৌহদ্দিতে দেখার চোখকে পরিণত রূপে দৃশ্যমান করেছেন কবি হাফিজ রশিদ খান। তাঁরই ভাষ্যে এই ভাবনার মৌলস্বর শোনা যাক, ‘… জানা গেল, ওই অঞ্চলে বসবাসরত এগারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে দশটিরই ভাষা, পোশাক–আশাক ও সাংস্কৃতিক বিন্যাস ভিন্নরকম। এবং এভাবে আমার অনুসন্ধিৎসু অন্তরও জেনে নিল ধীরে–ধীরে যে, জাতিসত্তাগত পঠন–পাঠনের আলোকে তারা তো ভিন্ন জাতিসত্তাই বটে। জনসংখ্যার ব্যাপকতা আর জনসংখ্যার ন্যুনতা জাতিগঠনের ক্ষেত্রে বা জাতি ধারণায় কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় নয়। কোনো জাতিসত্তার একটি মাত্র প্রাণও যদি অস্তিত্বমান থাকে কোনো ভূখন্ডে, ভাষাসহ জাতিত্বের স্বীকৃতি পাওয়া তার একান্ত অধিকার বটে। এভাবে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী পার্বত্য জাতিগুলো নিয়ে আমার ভেতর জাগে এক অদম্য কৌতূহল।’ খানের কবিতায় দেখা যায়, ‘প্রভু হে পুরনো দিনের কী চমৎকার/ বৈসাবি উৎসবে/ পাড়াগাঁর দীপান্বিত বাড়ির দাওয়ায়–দাওয়ায়/ অমরাবতীর পরিদের সঙ্গে কেটেছে/ নিভৃত সঙ্গমের কাল।’ কবিতার শরীরে এই সৃজনকলা এমনিতে ভর করে না। দীর্ঘ দিনের অবলোকন, গলাগলি আর ভাবনার ঐক্যে সমতলের ভূমিপুত্রের দ্বারা ‘আদিবাসী’ জীবনকে দেখা সম্ভব। একটি পরিপূর্ণ কবিমানস সেই ভাবনা বিস্তারে দেয় যাবতীয় শক্তি। ফলে বৈসাবি উৎসব খানিক অচিন হলেও চেনাজানা এমনকি পড়শি–সৌন্দর্য হয়ে আমাদের ভূবনে সুবাস ছড়ায়। আর বিকেলগুলো হয়ে উঠে আন্তরিক কারুকাজে মন্ডিত। সেখানে ছায়াপাত করে প্রেম আর থাকে চিরায়ত মায়ের দরদ। কবিতায় পড়ি, ‘অথবা অতিথিঘরের পাশে/ বয়ে–যাওয়া নদীটার পাড়ে এক সোনালি বিকেল/ আধভেজা বালু ও কাদামাটির কারুকাজে/ মায়ের দরদি মুখের মতন/ এঁকেছি এক নারীমূর্তি’। আদিবাসী কবিতার ভরকেন্দ্রে আছে মানুষ ও তার ভাষা। ফলে হাফিজ রশিদ খান হৃদয়ের তাগিদকে রূপান্তর করতে পেরেছেন শব্দের দ্রাঘিমায়। এবং তার এই চর্চা বাংলা ভাষাভাষীদের আদর পেয়েছে তুমুলভাবে, সাথে স্বীকৃতি–পুরস্কারের বরমাল্যও। বলা চলে, প্রায় তার একলার তৈরি করা পথ এখন বহু সাধকের সাধনায় রীতিমতো ঋদ্ধ।
আশির দশকে সাহিত্যযাত্রায় সামিল হওয়া হাফিজ রশিদ খান নিজে লিটলম্যাগে শুধু দুই হাতে লিখেই ক্ষান্ত হননি, সম্পাদনা করেছেন সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম লিটলম্যাগ ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’। এরপরে আরো কিছু ছোটকাগজ সম্পাদনায় থাকলেও ছোটকাগজকর্মীদের মনে জ্বলজ্বল করে তারই সম্পাদিত মার্জিত এক কাগজ ‘পুষ্পকরথ’। নামের মোহেই আমরা তখন মুগ্ধ। তিনি নিজেই লিটলম্যাগকে অভিহিত করেছেন, ‘লিটল ম্যাগাজিন প্রতিবাদের আরেক নাম।’ এবং সেই নীতিবোধের নিক্তিতে তিনি পাশমার্ক নিয়েই সাহিত্যও সম্পাদনা করতে এসেছেন বলেই বিশ্বাস করেন, ‘প্রতিবাদ, প্রচল সাহিত্য–রাজনীতি ও তৎকেন্দ্রিক কোটারি স্বার্থপ্রবণতার বিরুদ্ধে’ থাকে লিটলম্যাগ। বর্তমানে বিশুদ্ধ লিটলম্যাগ চর্চা যেমন প্রায় বিরল তেমনি স্খলন ঘটেছে সম্পাদনাকর্মে জড়িত অনেকের নিয়তে। ফলে আগডুম বাগডুম লেখাপত্রের সাথে যুক্ত হচ্ছে স্বার্থের সামিয়ানা। অথচ হোক তা পাহাড়ে কি সমতলে– লিটলম্যাগের বিস্তৃত পরিসরই তৈরি করতে পারে নিখুঁত ও প্রতিবাদী সাহিত্যকর্মী। স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তীতে লিটলম্যাগের শরীরে উদগত অগ্নিশিখা এখন প্রায় ম্লান হয়ে গিয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার গূঢ় অভিপ্রায়ে। তবুও দেশেরই প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চল থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগ আমাদের আশাবাদী করে– আমরা তাতে ঘ্রাণ পাই ‘পুষ্পকরথ’র। এই অবিনাশী যাত্রার অনিঃশেষ দ্রোহী ও নিষ্ঠ সচলতা আমাদের সাহিত্য ও জনজীবনের কল্যাণের সাথে জড়িত– একে থামিয়ে দেয়া ঠিক হবে না কোনভাবেই। আর দেখেছিলাম তাঁর দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পাদনার ধীমান– সৌম্যের রূপ। দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের সাহিত্যপাতা একদা তাঁর হাত ধরেই পেয়েছিল সুধিজনের শ্রদ্ধা। চট্টগ্রামে অবস্থানকারি বটেই সারাদেশের কবি–সাহিত্যিকদের সৃজন–ফসলে পরিপূর্ণ হয়েছে সেই পাতা; যার পশ্চাতে ছিল খানের গভীর শ্রম ও আন্তরিক প্রয়াস।
বলতে হয়, হাফিজ রশিদ খান তাঁর সময়কে উপভোগ করেছেন সৃজনের মত্ততায়। এমনকি, ভয়ঙ্কর করোনাকালে তিনি নিভৃতবাসে রচনা করেছেন বিপুল বিস্ময়। শুধু ‘চার গ্রহের বাসিন্দা’ গ্রন্থ হাতে নিলেই মস্তক শ্রদ্ধায় আনত হয় এই ভেবে, সমকালে অনুজ–অগ্রজদের নিয়ে এমন কষ্টসাধ্য কাজ আর ক’জনে করেছেন? এত নিবিড় অবলোকন, এত মমত্ববোধ, এমন স্নেহের স্পর্শ, এমন নিংড়ানো ভালোবাসা আমরা বস্তুত: পেতে অভ্যস্থ নই কিন্তু খান তা অবলীলায় ঢেলে দেন– দশজনের মতো মুখে প্রবঞ্চের বুলিতে নয়, গদ্যের শ্রমঘন মননশীলতায়। দেশের খ্যাতিমান শিল্পসাহিত্যজনের সাথে দূরপল্লীর তরুণ কবিতাকর্মী– বাদ পড়ে না তার চেনাজানার প্রায় কেউ–ই। এই ঋণ যেমন শোধের অতীত তেমনি এর দ্বারা তৈরিকৃত বৌদ্ধিক পথটাও সতত ক্রিয়াশীল থাকবে বলেই আমাদের ধারণা। নাতিদীর্ঘ গদ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের এই সংযোগ মূল্যবান এক দলিল হয়েই থাকবে আমাদের মননশীল সাহিত্যের দহলিজে। কবিতার বিশ্লেষণ, কথাসাহিত্যের স্বরূপ নির্ণয়, সম্পাদনার ষোলআনা– সব মিলিয়ে যার যে ধরণের কাজ, তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করেছে হাফিজ রশিদ খানের কলম। অগ্রজেরা অনুজদের নিয়ে ভাবে না, সমকালীন সতীর্থ সাহিত্যকর্মীরা ভোগে নিজেদেরই অন্ধ হিংসায়– এই ভাবনা বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন হাফিজ রশিদ খান তাঁর ‘চার গ্রহের বাসিন্দা’ গ্রন্থ দিয়ে। এখনো অনুজ কি অগ্রজদের নিয়ে লিখতে তাঁর আলস্য নেই। ব্যক্তিজীবনের মতোই ধীরে, নিরবে বয়ে চলে তার এই বড় হৃদয়ের কাজ।
কথা বহুরকমের হলেও, হাফিজ রশিদ খান মূখ্যত কবি। এদেশের স্বনামে খ্যাত কবিসমাজের সম্পন্ন গেরস্তী তিনি। ফলে, তাকে নিয়ে যত কথাই আসুক কবিতা অনুপস্থিত থাকলে তা হয় ওঠে প্রাণহীন। কবিতাকে তিনি দিয়েছেন উজাড় করে, এর পেছনেই তার পুরো জিন্দেগী। বড় বণিক কি ব্যবস্থাপক কত কী হবারই সযোগ ছিল বটে, হলেন ওই কবিতার রাখাল। আমরা পড়ি, ‘ও পাড়ার চিতাচুল্লি আর এ–পাড়ার গোরস্তান/ দুজনই গভীরর সহোদর:/ কবিতা বোঝে না কেউ সমানে সমান…’ আর কী লাগে পাঠকের? তিনি পাহাড়–সমতল চষে মানুষের পক্ষেই ওকালতি করেছেন। মিষ্টি একটা স্বর কবিতায় ছড়িয়ে দিলেও সময়ের প্রয়োজনে তা হয়েছে উচ্চকিত; পাহাড়ে গিয়ে তা জনসংস্কৃতি ও জনাচারের প্রতিনিধি। মানুষ ও মনুষ্যজীবন দেখা ও দেখানোর খেলায় খান বলেন, ‘পারিনি মানব হতে রয়ে গেছি/ মানুষেরে ঘিরে ঘোর কোলাহলে/ ফিরে–ফিরে মোহের তিমিরে/ সভায়, সরব মাহফিলে একটু আদর করে/ কেউ ডেকে নিলে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারের খোপে বসি/ চুপি চুপি মাথায় তাজের মতো পরে চিতিপড়া টুপি’। আহা, মানুষের মোহ, মোহের তিমির! মানুষ দেখার ভেতরে তিনি মানুষেরই পক্ষে থেকে যান, সে যে দেশের মানুষই হোক। সেই কবে, ইজরাইলি রক্তপায়ীদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, ‘… হে ইজরাইলি রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকবর্গ, তোমাদের ওই যৎসামান্য/ মানবিকতার জন্যে করুণাবর্ষণ করেও বলছি: তোমাদের পূর্ণ কোরামের সিনেট/ অধিবেশনে একটা ক্রোধান্ধ মিসাইল তবু ছুটে গেল আমারই একক/ অনুমোদনে…’ এই যে শত প্রতিকূলেও মানুষের পক্ষে থাকা, এটাই একজন মৌলিক কবির কাজ। আক্ষেপ ছিল আমাদের, কেন্দ্রের বাইরে থাকা কবি–সাহিত্যিকেরা খুব কমই সম্মানিত হোন রাষ্ট্রের দ্বারা, বড় প্লাটফর্ম দ্বারা। তাদের কবিতা–প্রবন্ধ ছাড়া হয়তো কেন্দ্রের সাহিত্যপাতা কি ছোটকাগজ অপূর্ণ থেকে যায় কিন্তু সম্মানিত করার ক্ষেত্রে এসব ‘বড় লেখক’দের নাম আসে অনেক পরে, কখনোবা আসেই না। যোগ্যদের মূল্যায়িত করা হলে পুরস্কারই পুরস্কৃত হয়। অনার লিস্ট নিয়ে গর্বিত হবার সুযোগ থাকে পুরস্কারদাতা কর্তৃপক্ষের। বাংলা একাডেমীর ‘সা‘দত আলী আখন্দ’ পুরস্কার লাভে মানুষের পক্ষের কবি হাফিজ রশিদ খানকে অতল শ্রদ্ধা।












