দিন দিন বেড়েই চলেছে দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা। গত অর্থবছরের (২০২২–২৩) তুলনায় চলতি বছরে (২০২৩–২৪) পাচারের ঘটনা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মূলত ব্যাংক লেনদেন, হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংক এবং গেমিং বোটিংয়ের মাধ্যমেই এসব ঘটনা ঘটছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সন্দেহে প্রায় সাড়ে ৫শ ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হয়। সেখানে লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনার জন্য যৌথভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিআইএফইউ) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে বিনিময় করা হয়। এর আগের অর্থবছরে ২৮৫টি ঘটনার তথ্য বিনিময় হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে খবরে প্রকাশ। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আরও প্রায় ১১ হাজার লেনদেনকে সন্দেহজনক তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্যক্তিগত ২৭ হাজার ৬৮০ মোবাইল ব্যাংক (এমএফএস) স্থগিত এবং ৫ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে।
সূত্রমতে, পাচার হয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬৫টি চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, আমরা আইনি প্রক্রিয়া মেনে সুইচ ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিঠি দিয়েছি। পাশাপাশি একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে ১৫টি দেশ বাংলাদেশকে অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে। সূত্রমতে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চলতি অর্থবছরে (২০২৩–২৪) প্রথম আট মাস জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাংক লেনদেন হয়েছে ২৩ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় তিনগুণ। পাশাপাশি একই সময়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৯ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এ লেনদেনও প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে বেশি।
আসলে দেশে থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। বিগত অনেক বছর ধরেই তা চলছে এবং দিন দিন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনোভাবেই অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনারও কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধগুলো বিশ্বের যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে; দেখা যাচ্ছে, সেখানে দুদকের মতো দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। মানি লন্ডারিং আইনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দুদকের হাতে থাকাকালীন ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনায় দুদকের সাফল্য থাকলেও পরে এ বিষয়ে সাফল্যের আর কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি। এ অবস্থায় দুদকের ক্ষমতা ও আইনি কাঠামো যে আরও সমপ্রসারিত করা দরকার, তা বলাই বাহুল্য।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থ পাচার একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। দেশের আর্থ–সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন সাধনে এ সমস্যা রোধ করতে হবে। এ জন্য সরকারি কৌসুলীদের সোচ্চার হতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। এ সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচারে অধিকতর আন্তরিক হতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘যে অর্থ বিদেশে যায়, তার বেশিরভাগই অপ্রদর্শিত বা দুর্নীতির অর্থ। আরেকভাবে যায়, সেটা হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে। এসব উপায়ে যে টাকা চলে গেছে, সেটা কিন্তু সুইস ব্যাংক এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্টেও দেখা যায়’। তাঁরা বলেন, ‘আসলে অনেকে বৈধভাবে অর্জন করার পরেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশে টাকা রাখতে নিরাপদ বোধ করেন না। আবার সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন, তাদের অনেকের টাকা অনেকাংশ বা কিছু অংশ থাকে অবৈধ উপায়ে অর্জিত। এগুলোকে পুরোপুরি সাদা টাকা বলা যাবে না। তারা এসব টাকা হয়তো উৎস জানিয়ে বৈধভাবে ব্যাংকে রাখতে পারবেন না, আবার কোনো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে না’।
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা গতিশীল রাখতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে দেশের টাকা দেশে থেকে যায়। মনে রাখতে হবে, অবৈধভাবে অর্থ পাচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ অর্থ পাচারকারীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। অর্থপাচার রোধে অবশ্যই পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।