অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

| রবিবার , ১৯ জুন, ২০২২ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

আসন্ন অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে অতি সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, এক বছরে সুইস ব্যাংকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ জমা করেছেন বাংলাদেশিরা। আর ২০২১ সাল পর্যন্ত জমা করা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। এর আগের বছর ২০২০ সালে ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশিদের আমানত দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি ফ্রাঁ ৯৫ টাকা করে ধরলে দেশি মুদ্রায় হয় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি। ঠিক এক বছর আগে, এই টাকার অঙ্ক ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি। অর্থাৎ এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। নির্দিষ্ট করে গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ না করলেও ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার তথ্য তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক। প্রতিবেদনে এখন পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া যায়, তাতে ২০২১ সালেই বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি আমানত ছিল সুইস ব্যাংকে। ২০০২ সালের মাত্র ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ আমানত, দুই দশকে বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। বৃদ্ধির হারও সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২১ সালে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একসময় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো পাচারকৃত অর্থের ব্যাংকিংয়ের জন্য জনপ্রিয় থাকলেও এখন লুক্সেমবার্গ, কেইম্যান আইল্যান্ড, পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, বারমুডার ও বাহামার ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছেন ধনীরা। তাঁদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এসব দেশের ব্যাংকগুলো। এমনকি তুরস্কও সমপ্রতি সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে। বাংলাদেশের অন্তত ২০০ বিত্তবান অর্থ পাচারকারী এ প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্কের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন করেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়। এছাড়া আরও অনেক দেশ পরোক্ষভাবে পাচারকৃত অর্থকে স্বাগত জানাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুইজারল্যান্ডে গোপনীয়তা কমতে থাকায় অনেক ধনী এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য অগ্রসর হচ্ছেন এসব দেশের ব্যাংকের প্রতি। অন্য সব ব্যাংকের হিসাব এই মুহূর্তে জানা না গেলেও সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘যে অর্থ বিদেশে যায়, তার বেশিরভাগই অপ্রদর্শিত বা দুর্নীতির অর্থ। আরেকভাবে যায়, সেটা হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে। এসব উপায়ে যে টাকা চলে গেছে, সেটা কিন্তু সুইস ব্যাংক এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্টেও দেখা যায়’। তাঁরা বলেন, ‘আসলে অনেকে বৈধভাবে অর্জন করার পরেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশে টাকা রাখতে নিরাপদ বোধ করেন না। আবার সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন, তাদের অনেকের টাকা অনেকাংশ বা কিছু অংশ থাকে অবৈধ উপায়ে অর্জিত। এগুলোকে পুরোপুরি সাদা টাকা বলা যাবে না। তারা এসব টাকা হয়তো উৎস জানিয়ে বৈধভাবে ব্যাংকে রাখতে পারবেন না, আবার কোনো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে না’।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা এবং বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় দেশের বাইরে, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকগুলোতে গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আসলে কোনো দেশই চায় না, তার দেশের উপার্জিত অর্থ অন্য দেশে ব্যবহৃত হোক। তাঁরা বলেন, মুদ্রা পাচার কখনোই বন্ধ হবে না যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশ এ ব্যাপারে সতর্ক এবং সচেতন না হয়। কারণ এটা দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম। যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয় তারা কখনোই তা বন্ধ করতে পারবে না, যদি মুদ্রা পাচারের গন্তব্য দেশটিও সতর্ক না হয়। কোনো দেশ যদি পাচারকৃত মুদ্রাকে তাদের দেশে অভ্যর্থনা জানায়, তাহলে কখনোই মুদ্রা পাচার বন্ধ হবে না। কিন্তু উদ্দিষ্ট দেশটি যদি পাচারকৃত মুদ্রা তাদের দেশে অভ্যর্থনা না জানায়, তাহলে এ কার্যক্রম এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই তাদের দেশে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পাচারকৃত অর্থকে স্বাগত জানায়।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এর একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশ থেকে প্রতিবছর নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ ১৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার (এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা) ছাড়িয়ে যেতে পারে।’ তথ্যটি খুবই উদ্বেগজনক। তাই বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে