অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের কঠোর বার্তা দিয়েছেন। তিনি অর্থ পাচারে জড়িতদের নামের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন পর্যালোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান আইনগুলো খতিয়ে দেখতেও বলেছেন তিনি। দেশে যাতে নতুন করে কালোটাকার জন্ম না হয়, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেন তিনি। অন্যদিকে প্রথম কার্যদিবসে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, যারা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত–সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের বের করতে হবে। এছাড়া তাদের অনিয়মে যারা সহায়তা করেছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থ পাচার নিয়ে অতীতে অনেক আলোচনা হলেও বাস্তবে পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালনের খবরও বেরিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকলেও উলটো সংস্থারটিরই ঊর্ধ্বতন কতিপয় সদস্য পাচারকারীদের সহায়তা করেছে। সংস্থাটির এক সদ্য পদত্যাগী অর্থ পাচারের সবকটি দরজা দুর্নীতিবাজদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ায় দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পালাবদলের এ প্রেক্ষাপটে কেউ যাতে অর্থ তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে, তা প্রতিরোধে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দকরণসহ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আশার কথা, ঐ বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা এসব বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ২০২২–২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩–২৪ অর্থবছরে পাচারের ঘটনা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মূলত ব্যাংক লেনদেন, হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংক এবং গেমিং বোটিংয়ের মাধ্যমেই এসব ঘটনা ঘটছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সন্দেহে প্রায় সাড়ে ৫শ ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হয়। সেখানে লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনার জন্য যৌথভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিআইএফইউ) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে বিনিময় করা হয়। এর আগের অর্থবছরে ২৮৫টি ঘটনার তথ্য বিনিময় হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য তখন পাওয়া গেছে বলে খবরে প্রকাশ। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আরও প্রায় ১১ হাজার লেনদেনকে সন্দেহজনক তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্যক্তিগত ২৭ হাজার ৬৮০ মোবাইল ব্যাংক (এমএফএস) স্থগিত এবং ৫ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে।
আসলে দেশে থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। বিগত অনেক বছর ধরেই তা চলছে এবং দিন দিন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনোভাবেই অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনারও কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধগুলো বিশ্বের যেসব দেশে সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে; দেখা যাচ্ছে, সেখানে দুদকের মতো দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। মানি লন্ডারিং আইনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দুদকের হাতে থাকাকালীন ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনায় দুদকের সাফল্য থাকলেও পরে এ বিষয়ে সাফল্যের আর কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি। এ অবস্থায় দুদকের ক্ষমতা ও আইনি কাঠামো যে আরও সমপ্রসারিত করা দরকার, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থ পাচার একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। দেশের আর্থ–সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন সাধনে এ সমস্যা রোধ করতে হবে। এ জন্য সরকারি কৌঁসুলিদের সোচ্চার হতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। এ সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচারে অধিকতর আন্তরিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, অবৈধভাবে অর্থ পাচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ অর্থ পাচারকারীদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তা না হলে এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে বলে মনে হয় না।