অর্থব্যবস্থা ও অভিশপ্ত পাচার অপসংস্কৃতি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

১৭ ডিসেম্বর ২০২১ গণমাধ্যমে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, দেশ থেকে অস্বাভাবিকভাবে টাকা পাচার বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিগত ৬ বছরে প্রায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা (৪৯৬৫ কোটি ডলার) পাচার হয়েছে। ঐ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। শুধু ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। প্রতিবেদন মতে, দুইটি প্রক্রিয়ায় তথা বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রাপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) এর মাধ্যমে বেশি টাকা পাচার হয়েছে। সংস্থাটির তথ্যানুসারে, পাচারকৃত টাকা দেশের চলতি বছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান এবং এক বছরে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে দেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক শীর্ষ পাচারকারীদের নাম-তালিকা প্রচার এবং এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ জনের অধিক সংখ্যক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
উপরোল্লেখিত প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩৪টি দেশের অর্থ পাচারের তথ্য অবহিত করা হলেও ২০১৫ সালের তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। জিএফআই’র সিনিয়র ইকোনমিস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক তথ্য না পাওয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আলোচ্য সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে এক দশমিক ছয় ট্রিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রতি বছর ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। বাংলাদেশ থেকে এসব অর্থ যাচ্ছে পৃথিবীর ৩৬টি দেশে। সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে ১০টিতে। মূলত অর্থ পাচারের কারণ হিসেবে তাঁরা বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতিকে উল্লেখ করেছেন। আমাদের সকলেরই জানা, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু চলতি অর্থ বছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হওয়া ও বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ স্বল্পতায় টাকা পাচার হচ্ছে বলে তাদের ধারণা। বর্তমান আইন-কানুনের আধুনিকায়নের শতভাগ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের সংস্থাসমূহকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আবশ্যিকতা সম্পর্কেও তাঁরা মতামত পোষণ করেন।
সম্প্রতি বিগো লাইভ ও লাইকির মাধ্যমে প্রতি মাসে শত কোটি টাকা পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। পরিমাণে অল্প হলেও, টাকা পাচারের নতুন মাধ্যম হিসেবে এসব অ্যাপসের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পুলিশ অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, রাশিয়ায় বসে তিন বাংলাদেশি দুটি ওয়েবসাইট খুলে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে সারা দেশ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে একটি চক্রের সদস্যরা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঢাকার এক ক্যামেরা ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাবে জমা করে এর একটি অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির পর বাকি অংশ রাশিয়ায় চক্রপ্রধানের নিকট পাচার হচ্ছে। সারা দেশে অনলাইন জুয়া পরিচালনার সঙ্গে জড়িত শতাধিক ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। এরই মধ্যে তারা এই চক্রের ১৫ জন সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। সিআইডির সাইবার ক্রাইম স্টেশনের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) বলেন, “ঋণপত্র বা এলসি খুলে রাশিয়া ও দুবাই থেকে কিছু ক্যামেরা এনে বিক্রি করেন ওই ব্যবসায়ী। তবে তার অধিকাংশ ক্যামেরা আসে আকাশ পথে ‘লাগেজ পার্টির’ মাধ্যমে। তিনি আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়েও টাকা পাচার করেন।”
২ মে ২০২১ প্রকাশিত জিএফআই এর অপর প্রতিবেদনের তথ্যসূত্র মতে, ২০১৪ সালে বিদেশে অর্থপাচার হয়েছে ৯১১ কোটি ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫-২০১৪ সময়কালে অর্থপাচারের পরিমাণ ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার যার দেশীয় মুদ্রামান ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। উক্ত সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে ২০০৪-২০০৫-২০০৬-২০০৭-২০০৮-২০০৯-২০১০-২০১১-২০১২-২০১৩-২০১৪ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ-৪২৬ কোটি ২০ লাখ-৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ-৪০৯ কোটি ৮০ লাখ-৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ-৬১২ কোটি ৭০ লাখ-৫৪০ কোটি ৯০ লাখ-৫৯২ কোটি ১০ লাখ-৭২২ কোটি ৫০ লাখ-৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ এবং ৯১১ কোটি ডলার। ২৭ নভেম্বর ২০২০ জার্মানির আন্তর্জাতিক ব্রডকাষ্টার ‘ডিডাব্লিউ’র প্রতিবেদন অনুসারে বিগত ১০ বছরে দেশের দু’টি বাজেটের সমপরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র সূত্রানুযায়ী, ২০১৩ সালে পাচারকৃত অর্থ যথাক্রমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাজেটের ৩.৬ গুণ ও ৮.২ গুণের অধিক এবং মোট দেশজ উৎপাদনের সাড়ে ৫.৫ শতাংশ। এছাড়াও বিদেশে বিনিয়োগ বা মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে সেকেন্ড হোম প্রতিষ্ঠায় অবৈধ অর্থপাচারের সঠিক তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রমতে অর্থপাচারের পরিমাণ এক্ষেত্রেও অনেক বেশি। সুইজারল্যান্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘এসএনবি’র ২০১৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঐদেশের ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশীদের অর্থ আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৪ শত ৮ কোটি টাকার বেশি।
২০১৯ সালের মে মাসে ‘পানামা পেপারস’-এ প্রকাশ পেয়েছে, বাংলাদেশের অন্তত ৫০ ব্যক্তি ও ৫টি প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে অফশোর কোম্পানি স্থাপন করেছে। কর ফাঁকি দিয়ে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থপাচার আরেক ধরনের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। ‘ডিডাব্লিউ’র প্রতিবেদন মতে কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম আর সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে ৮ হাজার কোটি টাকার সম্পদ-জামানত দেশবাসীকে চরম হতবাক করেছে। কানাডায় অর্থপাচারকারী ২৮ জনের তালিকার মধ্যে ২৪ জনই সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর বাকি ৪ জন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। সরকারি কর্মকর্তাদের এত বিশাল অর্থার্জন ও বিদেশে পাচার দেশের সচেতন নাগরিকদের মাঝে প্রকট কৌতুহল এবং হতাশার বিঘটন উন্মোচন করেছে। দুদকের সম্মানিত আইনজীবী জানিয়েছেন, একজন বাংলাদেশির সিঙ্গাপুরের এক ব্যাংকে ৮ হাজার কোটি টাকা আমানত রয়েছে। ব্যক্তির নাম প্রকাশ না করে ঐ টাকা ফেরৎ আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
শিল্পকারখানা-পরিবহন-নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি-সেবাসহ সকল খাতকে তদন্তের আওতায় এনে অর্থ পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জোর দাবি দেশব্যাপী উচ্চকিত। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সময়ে সময়ে সিন্ডিকেটের কারসাজির দোহাই দিয়ে খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রেও অর্থপাচারের বিষয়টি কতটুকু আড়াল করা হচ্ছে তাও নির্ধারিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দুর্নীতি বিরোধী বিভিন্ন সংস্থার মতানুসারে, অর্থপাচারের যে চিত্রটি প্রকাশ পাচ্ছে; প্রকৃত চিত্র তার চেয়েও ভয়াবহ। এসব সংস্থার মতানুসারে মোট বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়। দু:খজনক হলেও সত্য যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আমদানিকৃত শিল্পের যন্ত্রপাতি ভর্তি কন্টেইনারে পাওয়া গেছে ছাই-ইট-বালি-পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কন্টেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ভুয়া রপ্তানি ঋণপত্র এবং ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে টাকা পাচারের বেশকিছু ঘটনাও উন্মোচিত হয়েছে। নুন্যতম বিগত ১০-১২ বছরে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা কখন কীভাবে কোন ধরনের পণ্য-যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম-ক্রেন-পুঁজি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানি-রপ্তানি ও এর ব্যবহার সম্পর্কে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের যথাযথ জ্ঞাত হওয়া দেশের স্বার্থে অপরিহার্য। সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমূহের দেশপ্রেমিক-সৎ-যোগ্য-দক্ষ ও চৌকস সদস্যদের সমন্বয়ে গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য অনুধাবনের উদ্যোগ ব্যাহত হলে দেশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে চরম আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
সমকালীন দেশের অর্থব্যবস্থা পরিচালনার দৃশ্যপট বিশ্লেষণে দরিদ্র-নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অতি কষ্টে ব্যাংকে সঞ্চিত আমানত বিশ্বাসযোগ্য নিরাপদ নয় বলে ভোক্তাসমাজের ধারণা। জনশ্রুতিমতে শিল্পকারখানা ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যক্তি বা বেসরকারি পর্যায়ে ঋণগ্রহীতার অসৎ উদ্দেশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্মোচিত। নদী-সমুদ্র-জলাশয়-খাসজমি বন্ধক রেখে অবৈধ-অনৈতিক যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণের নামে অর্থ লুন্ঠন বিনিয়োগের নতুন প্রকরণ ‘খেলাপি ঋণ’ হিসেবে বিবেচ্য। দেশবাসীর কাছে অতি সুপরিচিত হাতেগোনা স্বল্প সংখ্যক নষ্ট উদ্যোক্তাদের করায়ত্তে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পবিত্র আমানত এক ধরনের কৌতুহলী ক্যাসিনোরূপ পরিগ্রহ করেছে। দৃষ্টিগোচরে আসা সামান্য কিছু অবয়ব পরিলক্ষিত হলেও; খেলাপি ঋণের বিশাল অংশ অর্থ পাচারের মোড়কে বহির্দেশে এসব পাপিষ্ঠদের পর্বতসম সম্পদ পুঞ্জিভূত করছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে, খেলাপি ঋণের অধিকাংশ অর্থ আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং, রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
২৪ নভেম্বর ২০২১ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনিং বিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ১৫০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকার বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধিতে গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ১৯ নভেম্বর ২০২১ তারিখে প্রকাশ হওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন এপ্রিল-জুন ২০২১’ এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা পাঁচ ব্যাংকেই আছে ৪৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক। শীর্ষ পাঁচসহ ১০ ব্যাংকে রয়েছে ৬২ হাজার ৩৯৪ কোটি এবং বাকি ৪৯ ব্যাংকে আছে ৩৬ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। উল্লেখ্য প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭ লাখ কোটি টাকা। তন্মধ্যে গ্রাহকের নিকট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ লাখ কোটি এবং বাকিগুলো অন্যান্য সম্পদ। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৮ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ ৮৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৮৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। সন্দেহজনক ঋণ ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা যা মোট খেলাপি ঋণের ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।
১৮ নভেম্বর ২০২১ প্রকাশিত উল্লেখ্য সূত্রমতে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও ১০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে যার একটি বৃহৎ অংশ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা নানা জালিয়াতি করে লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নামে-বেনামে ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় প্রদত্ত ঋণগুলো আদায় না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ আদায়ে মামলা করতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থঋণ ও অন্য আদালতে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৩২টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত গণমাধ্যম সূত্রে, মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি ও বিশেষায়িত মোট ১১টি ব্যাংক বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। যার মধ্যে সরকারি পাঁচটি, বিশেষায়িত দুটি এবং বেসরকারি খাতের চারটি। জুন মাস শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা।
বিভিন্ন অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় উপার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনায় যারপরনাই দেশবাসী চরম ক্ষুব্ধ। অবশ্যই এসব দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং বিভিন্ন সংস্থার গৃহীত উদ্যোগ প্রসংশার দাবি রাখে। দেশের আইনের শাসন সুরক্ষা এবং জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে গণমানুষের কষ্টার্জিত মেধা-শ্রমের বিপরীতে প্রদেয় কর-ভ্যাট ইত্যাদির লুন্ঠনে স্বল্প সংখ্যক ঘৃণ্য ব্যক্তির লোভ লালসায় কূট চরিত্রের বহি:প্রকাশ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান সরকার তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে অকল্পনীয় বিস্ময়কর অর্জন এবং বিশ্বে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রকে সুমহান মর্যাদায় আসীন করার অভূতপূর্ব অহংবোধকে ন্যূনতম ম্লান করা যাবে না।
আপামর দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এই দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে অব্যাহত শক্তিমান করবে- নি:সন্দেহে তা বলা যায়। নিকট অতীতের সামগ্রিক সন্ত্রাস-দুর্নীতি-জঙ্গিবাদ বিরোধী সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উঁচুমার্গে সমাদৃত। সচেতন মহলের ধারণা বিশ্লেষণে পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে ভারত-মিয়ানমার ও দেশের কতিপয় অসাধু অর্থলিপ্সু হিংস্র নরপশুদের যোগসাজশে হুন্ডি-মাদক ব্যবসা-চোরাচালান-চিকিৎসা-স্বাস্থ্য-আবাসন খাতে বিনিয়োগে কল্পনাতীত পরিমাণ অর্থ পাচার নিয়মিত অব্যাহত রয়েছে।
এসব হিসাব কোনভাবেই আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে যথাযথভাবে প্রচার-প্রকাশ-আইনি কাঠামোর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বস্ত গোয়েন্দা-গণমাধ্যম সূত্রকে কাজে লাগিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে দেশের অর্থ ব্যবস্থা অদূর ভবিষ্যতে কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধসংযুক্ত যমজ দুই ভাই পেলেন সরকারি চাকরি বেতনও ২ জনের