এটি সর্বজনবিদিত যে, যেকোন জাতিরাষ্ট্রের সার্বিক আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক কাঠামোর দৃঢ়তা আবশ্যক। সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় ব্যাংক–বীমাসহ সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঋণ খেলাপি, অর্থপাচার, অনৈতিক ঋণ–সুদ মওকুফ ও বিভিন্ন সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেপরোয়া দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। দুদক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা এসবের তদন্ত নিয়ে খুবই ব্যতিব্যস্ত। সরকারি কর আদায়ে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমূহের কতিপয় অসাধু ব্যক্তির কারণে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা গোচরীভূত হচ্ছে। বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক নানামুখী নির্দেশনা কার্যকরেও অন্তরায় পরিলক্ষিত। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে দেশের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের তথ্য–উপাত্ত উপস্থাপিত। হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করে রপ্তানি আয় থেকে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্টদের মতে, জিডিপির আকার–প্রবৃদ্ধি–মাথাপিছু আয়সহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো পরিমাপের অন্যতম অনুষঙ্গ এ রপ্তানি আয়। সংশোধনের মাধ্যমে রপ্তানি আয় কমে আসায় এসব সূচকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। জনশ্রুতি মতে, দীর্ঘসময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে সমস্যাসমূহ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অনিয়ম–কেলেঙ্কারি–দুর্বল কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে ঋণ খেলাপি বেড়েছে। ৬ জুন ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি বেড়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যা পূর্বের তিন মাসের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র পরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ৮৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। সর্বাপেক্ষা বেশি মন্দ ঋণ কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনতা ব্যাংকের। যার পরিমাণ ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ২৮ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ ৮৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা যা তাদের বিতরণ করা ঋণ ১২ লাখ ২১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়াও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে তাদের বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণ যথাক্রমে ৫ দশমিক ২০ ও ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি অবলোপনকৃত–পুনঃনির্ধারিত ঋণ এবং আদালতে নিষেধাজ্ঞা আছে এমন ঋণ বিবেচনা করা হয় তবে মন্দ ঋণের প্রকৃত সংখ্যা হবে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক গণমাধ্যমে বলেন, ‘খেলাপি ঋণের এই পরিসংখ্যান নতুন নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে এটি এখন সামনে এসেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এতে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। অনেক মন্দ ঋণ আছে যেগুলো এখনো প্রকাশ হয়নি। ভবিষ্যতে সেগুলো প্রকাশ করা হবে। উচ্চ মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং ভালো ঋণগ্রহীতাদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে।’ ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের দাবি, একদিকে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ থেকে বিরত থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরপক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ ঋণই অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। তাই সেসব ঋণ আদায় করা কঠিন। তাছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাছবিচার ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতেও অনেক ঋণ খেলাপি পুনঃতফসিলের আশ্রয় নেয়।
একই পরিক্রমায় অর্থপাচার বৃদ্ধির দৃশ্যাদৃশ্যও গভীর অনুভূত। অর্থপাচার করে বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলার প্রবণতাও অতীতের তুলনায় বেড়েছে। পাচার হওয়া সম্পদের অধিকাংশই দুর্নীতি ও অবৈধ পন্থায় উপার্জিত। অর্থ–সম্পদ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে মোট ১৪ হাজার ১০৬টি। ২০২১–২২ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি। অর্থাৎ এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫৩৫টি। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে গড় অর্থ পাচারের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩ তম।
সচেতন মহলসহ দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, অনিয়ম–দুর্নীতি–অব্যবস্থাপনা–পর্যাপ্ত তদারকি–দায়িত্বহীনতায় দেশের ব্যাংকিং খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দীর্ঘদিন ধরে এই খাত নিয়ে প্রচুর আলোচনা–সমালোচনা চলমান আছে। নজিরবিহীন তারল্য সঙ্কটের কারণে ঋণ প্রদান বা বিনিয়োগ সঙ্কুচিত হয়েছে। ৩০ জুন ২০২৪ সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যসূত্রে জানা যায়, দেশের ইসলামি ধারার ছয়টি ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এসব ব্যাংকে জমা হওয়া আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় এসব ব্যাংককে জামানত ছাড়াই টাকা ধার দিচ্ছে এবং লেনদেন হিসাব চালু রেখেছে। এ কারণেই মূলত ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এসব ব্যাংককে ঝুঁকি নিয়ে টাকা ধার দিলেও যথাযথ তদারকি করছে না। ফলে সংকটও কাটছে না।
যদিও ব্যাংকগুলোর তদারকির ক্ষেত্রে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের। প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যা কিছু করার এবং যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সবই আমরা করছি। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বর্তমানে আমরা যে মুদ্রানীতি অনুসরণ করছি, সেটির প্রভাবেই ব্যাংকখাতে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার লক্ষ্যে গতবছরের মতো এবারও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে, যা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমরা লক্ষ্য রাখছি যেন এর প্রভাবে খুব বাজে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। এছাড়াও ব্যাংকিংখাতের এই তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে আশ্বস্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২ জুলাই ২০২৪ সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল ও প্রকাশে করা রিট শুনানিতে উচ্চ আদালত মন্তব্য করেন যে, ‘দুর্নীতি–অর্থপাচার সুশাসন ও উন্নয়নের অন্তরায়। তাই যেকোনো মূল্যে দুর্নীতি–অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ গড়তে হবে। ঘুষ–দুর্নীতি–অর্থপাচার দিয়ে সোনার মানুষ গড়া যায় না। এর জন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সমাজের সব শ্রেণি–পেশার মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। সবাইকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’ শুনানি শেষে সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সম্পদ বিবরণীর ঘোষণা এবং সময়ে সময়ে দাখিলের বিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়নসহ তিনমাসের মধ্যে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এটি সুস্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের সার্বিক তদারকি কার্যকর থাকলে উল্লেখ্য অপ্রত্যাশিত কর্মকান্ড অনেকটুকু রোধ করা সম্ভব হতো। উদ্ভূত পরিস্থিতি উত্তরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। সুশাসনের মাধ্যমে সকল অনিয়ম–দুর্নীতি–জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে অধিকতর মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। অর্থপাচার রোধে নিতে হবে ফলপ্রসূ কার্যকর ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বলিষ্ঠ ভূমিকা একান্ত কাম্য। সকল ধরনের অর্থব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেশের অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে হোক তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংকসহ পুরো অর্থব্যবস্থাকে সুরক্ষায় কঠিন থেকে কঠিনতর পদক্ষেপ গ্রহণ ও দৃশ্যমান সফলতা অর্জন সময়ের জোরালো দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।