অর্থপাচারের ভয়াবহ চিত্রে জাতি আতঙ্কিত

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

বিগত পতিত সরকারের আমলে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে অর্থপাচারের এতসব পরিসংখ্যান কখনো প্রকাশ পায়নি। জুলাই ২৪ ছাত্রজনতার অন্দোলনের ফলশ্রুতিতে রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অসাধারণ মেধাপ্রজ্ঞার সমীকরণে দারিদ্র দূরীকরণে তাঁর উদ্ভাবনী তত্ত্ব বিশ্বদরবারে তাঁকে সুমহান মর্যাদায় করেছে সমাসীন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে নানামুখী সংস্কার কার্যক্রমের কঠিন দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হন। বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে বিগত সরকারের আমলে সকল স্তরের অসঙ্গতিগুলোকে উপস্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক যাবতীয় দুর্নীতি, লুটপাট ও ভয়ংকর চৌর্যবৃত্তির উদঘাটন জরুরি হয়ে পড়ে। ২৮শে আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অতি উচুমার্গের গবেষণা কেন্দ্র সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের সুধীজনসহ আপামর জনসাধারণ বিষয়সমূহ সম্পর্কে প্রায় অন্ধকারে ছিল। বিভিন্ন সূত্রে সামান্য কিছু অবগত হলেও এত কদর্য বর্বরতায় অর্থ লুণ্ঠনের দৃশ্যপট কখনো কল্পনাই করা যায়নি। অতিসম্প্রতি ৩০ অধ্যায় সম্বলিত প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্র মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি এ প্রতিবেদনকে একটি যুগান্তকারী কাজ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রতিবেদন গ্রহণকালে উত্থাপিত বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। জুলাইআগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যে অর্থনীতি পেয়েছি তা এখানে দেখা যাবে। এই দলিল থেকে জাতি উপকৃত হবে। এতে আমরা জানবো, আমাদের রক্ত চুষে তারা কীভাবে অর্থনীতিকে লুণ্ঠন করেছে। দুঃখের বিষয় হলো তারা প্রকাশ্যে অর্থনীতি লুট করেছে এবং আমাদের বেশিরভাগই এর মোকাবেলা করার সাহস করতে পারিনি। এমনকি লুণ্ঠনের ঘটনার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণকারী বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোও অনেকাংশে ছিল নীরব।’

উক্ত প্রতিবেদনে বিগত সরকারের আমলের টাকা পাচারের আনুমানিক চিত্র তুলে ধরা হয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস), আইএমএফের উপাত্ত, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা, প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে করা শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে অর্থ পাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। টাকা পাচারের বিষয়টি অর্থনীতিতে ক্ষতিকর টিউমার। বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি ও সম্পদের বড় অংশ এই ক্ষতিকর টিউমার চুষে নেয়। শ্বেতপত্রে উপস্থাপিত তথ্যানুসারে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মতে, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। তাছাড়া ২০২৩২৪ অর্থবছরের রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় থেকে যত অর্থ এসেছে তার একপঞ্চমাংশ এবং বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে আসা অর্থের দ্বিগুণ পরিমান টাকা এক বছরে পাচার হয়েছে।

দেশ থেকে কারাকীভাবেকোথায় টাকা পাচার করেছে শ্বেতপত্রে তার বিশদ বর্ণনায় প্রতিফলিত হয়েছে যে, টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদব্যবসায়ীআর্থিক খাতের ক্রীড়ানকআমলাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষদুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি ইত্যাদি কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়। অর্থপাচার হওয়া দেশের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ করের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছোট ছোট দেশ। মূলত বাড়ি ক্রয় এবং ব্যবসায় বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে টাকা পাচার করা হয়। শ্বেতপত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যউপাত্তের উদাহরণ উপস্থাপিত হয়েছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি রিপোর্টের (২০২৪) তথ্য অনুযায়ী, দুবাইতে ৪৫৯ বাংলাদেশির ৯৭২টি আবাসিক স্থাপনা রয়েছে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। উক্ত সংস্থার ২০২৩ সালের প্রতিবেদন মতে, ‘করের স্বর্গ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে রয়েছে বাংলাদেশিদের প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সম্পদ। ‘এন্ড স্নো ওয়াশিং’ নামক সংস্থার প্রতিবেদনে কানাডায় বাংলাদেশিদের ৫ লাখ ৬৪ কোটি থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো সম্পদের প্রাক্কলন করা হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশিদের ৩ হাজার ৬০০ বেশি স্থাপনা রয়েছে।

১ ডিসেম্বর ২০২৪ শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করার মাধ্যমে অর্জিত যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার বোঝা পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে তাদের ঘাড়ে বহন করতে হতে পারে। দেশের যত ধরনের ক্ষতি করা যায় তার সবকিছু করেই তারা অর্থ বাইরে নিয়ে গেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগে দুর্নীতির অর্থের বড় অংশ দেশের অভ্যন্তরে ছায়া অর্থনীতিতে (শ্যাডো ইকোনমি) থাকত। অর্থাৎ দুর্নীতির টাকা দেশেই বিনিয়োগ হয়েছে। এতে সরকার হয়তো রাজস্ব পায়নি কিংবা মূলধারার অর্থনীতিতে ওই অর্থ আসেনি; কিন্তু তা কর্মসংস্থানে অবদান রেখেছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, দুর্নীতির বড় একটি অংশ দেশের বাইরে চলে গেছে।’ বিশ্লেষকদের দাবি, গত দেড় দশকে টাকা পাচারের স্বর্গরাজ্য ছিল বাংলাদেশ। সরকারের অন্তত সাতটি নজরদারি সংস্থা থাকার পরও সবার নাকের ডগায় এই বিপুল অঙ্কের টাকা চলে গেছে বিদেশে। মূলত দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, নজরদারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ অন্তত এক ডজন কারণে টাকা পাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষদুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীএমপিসহ প্রভাবশালীরা যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তার বেশির ভাগই তারা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ৭০ জনের বেশি মন্ত্রীএমপি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা এই পাচারের সঙ্গে জড়িত। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তাদের মতে, দুদকের আমলে নেয়া অভিযোগ এবং কমিশনের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে প্রায় সব মন্ত্রীএমপির বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউতে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিদেশে সম্পদের তথ্য চেয়েও এমএলএআর করা হয়েছে।

আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জোরালো উদ্যোগ পরিলক্ষিত। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও সম্মানিত অর্থ উপদেষ্টার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চকিত। উভয়েই আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সহায়তা চেয়েছেন। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় টাস্কফোর্স গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদকের মত ৭টি প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদক শুধু ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থের মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। বাকি ২৬টি সম্পূরক অপরাধের তদন্তভার সিআইডি, এনবিআরসহ অন্যান্য সংস্থাসমূহের নিকট ন্যস্ত রয়েছে।

সার্বিক পর্যালোচনায় সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, চিহ্নিত স্বল্পসংখ্যক ক্ষমতার সুবিধাভোগীরাই দেশ বিধ্বংসী কাজে লিপ্ত ছিল। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অর্থলিপ্সু হিংস্র মাফিয়াচক্র অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিল। সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ বা রাজস্ব আয় নানা কারসাজিতে ব্যাংক লুণ্ঠনের সমান্তরাল অর্থ পাচারের কদর্য চিত্রপট তৈরি করেছে। দ্রুততর সময়ের মধ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ দেশের আর্থিক খাতকে অবশ্যই সুদৃঢ় অবস্থানে উন্নীত করবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই অর্থের যোগান কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেই।

লেখক

শিক্ষাবিদ, সমাজঅপরাধবিজ্ঞানী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধঅর্ধযুগেও শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ