অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে পরিকল্পনা জরুরি

| রবিবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

যতই দিন যাচ্ছে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাম্প্রতিক জরিপেও এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৩ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোভিড মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশে ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার কমার খবর দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোবিবিএস। তবে দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও এই সময়ে পরিবার প্রতি খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আবার গত ছয় বছরে মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ২০২২ সালে করা জরিপ অনুযায়ী সংস্থাটি বলছে, দেশে মানুষের মাসিক আয় বেড়ে বর্তমানে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা হয়েছে। যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আবার পরিবার প্রতি খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। সর্বশেষ যখন ২০১৬ সালে হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এঙপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) করা হয়, তখন দেশে পরিবার প্রতি খরচ ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।

দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, সেটির প্রমাণ মিলল পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে। পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, পরপর দুই দফায় বৈষম্যের হার বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় ও ব্যয়, সবই কম। তবে শহরে আয় বৈষম্য বেশি, গ্রামের পরিস্থিতি তুলনামূলক কিছুটা হলেও ভালো। গত বুধবার পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার আরো কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে বিবিএস এর প্রাক্কলনে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।

জরিপের তথ্য বলছে, দেশের সামস্টিক অর্থনীতির এত সফলতার মধ্যেও দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে। ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে আয় বৈষম্য বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল শুন্য দশমিক ৪৮২ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সাম্প্রতিককালের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয় বেশকিছু সূচকের ঊর্ধ্বগামী গতিধারা। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীতে টানেল, তৃতীয় পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম। এছাড়াও জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি গড় আয়ু বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বার্তাই প্রকাশ করে থাকে। দেশের এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝেও যে তথ্যটি একটি নেতিবাচক অবস্থার জানান দেয় তাহলো অর্থনৈতিক বৈষম্য।

এই বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, আয়বৈষম্যকে নিরসন না করলে শ্রমজীবী প্রান্তিক জনগণের দারিদ্র্য নিরসন হবে না। তিনি বলেন, “বর্তমান সরকার শুধু মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েই মাতামাতি করছে। আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ফসল যে সমাজের উচ্চবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্তদের দখলে চলে যায় সেটা জনগণের কাছ থেকে লুকোতে চাইছে তারা। প্রান্তিক অবস্থানের শ্রমজীবী জনগণ এহেন প্রবৃদ্ধি থেকে তেমন সুফল পায় না। সরকার যেহেতু ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’র পথ অনুসরণ করে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’কে সোৎসাহে চালু রেখেছে তাতে আয়বৈষম্য নিরসনের কোন তাগিদ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে পরিদৃষ্ট না হওয়াই স্বাভাবিক। আয়বৈষম্যের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারের এই দুঃখজনক অমনোযোগ অগ্রহণযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দেশটি অচিরেই একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হবে তা আমরা কিছুতেই মেনে নেবো না।”

অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থনীতির প্রকৃত উন্নয়ন দেখতে হলে বণ্টন ব্যবস্থায় ন্যায্যতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরাতে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বর্তমান অবস্থা থেকে আর্থিক উত্তরণে অর্থনীতিবিদরা ইতোপূর্বে কয়েকটি পথের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, আর্থিক মন্দা থেকে প্রভাবমুক্ত হতে হলে সরকারের ব্যয় সংকোচন, সরকারিবেসরকারি ঋণ পুনর্গঠন, ধনীর সম্পদ গরিবদের মধ্যে পুনর্বণ্টন ও নগদ টাকা ছাপানো যেতে পারে। এ চার কর্মপদ্ধতি অর্থনীতির তুলনামূলক মসৃণ উত্তরণ ঘটানোর শ্রেষ্ঠ পথ।

এখন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে সেখানে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেখানেও সুষম কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো গড়ে তুলতে হবে সুষমভাবে। বেসরকারি খাতের উপযোগী কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানব সম্পদের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকেও সংগতিপূর্ণ করা দরকার। প্রয়োজনে কারিগরি ও বিশেষায়িত শিক্ষার সমন্বয় করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে