এডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনক বলা হয়। কারণ অর্থনীতিকে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে তিনি প্রথম উপস্থাপন করেন। এ বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ১৭২৩ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি গ্রীক ভাষা, ল্যাটিন ভাষা, গণিত শাস্ত্র ও দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। গ্লাসগো ও অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শেষ করে তিনি প্রথমে ধর্মযাজক হতে স্থির করেন। পরবর্তীতে মত পরিবর্তন করে এডিনবরায় ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তর্কশাস্ত্রের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। পরবর্তী বছর তিনি দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ সময় তিনি দর্শন শাস্ত্রের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থ রচনা করে তিনি প্রচুর সুখ্যাতিও অর্জন করেন। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপনা করতে করতে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে মনোযোগী হন।
এ সময়ে এডাম স্মিথ এক তরুণ ডিউকের (রাজপুত্র) ভ্রমণকালীন শিক্ষক হিসেবে নতুন চাকরি পান। এ চাকরি গ্রহণ করে তিনি প্রচুর অর্থ আয় করেন। চাকরিরত অবস্থায় ১৭৬৪ সালে তিনি একটি গ্রন্থ লিখা আরম্ভ করেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর তিনি গ্রন্থটির লেখা শেষ করেন। তিনি রাজপুত্রকে শিক্ষা দিতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন যে, রাজা রাজ্য শাসন করে ঠিকই তিনি কিন্তু অর্থনীতি সম্পর্কে অবগত নয়। এ কারণে অবসরে যাওয়ার ১০ বৎসর পর তিনি গ্রন্থটি ১৭৭৬ সালে প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির নাম ছিল ুঅহ ঊহয়ঁরৎু রহঃড় ঃযব হধঃঁৎব ধহফ পধঁংবং ড়ভ বিধষঃয ড়ভ হধঃরড়হংচ। যদিও এই গ্রন্থটিকে সংক্ষেপে ্তুডবধষঃয ড়ভ ঘধঃরড়হং্থ- বলা হয়। এ গ্রন্থ রচনা কালে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব আরম্ভ হয়। ফলে সবক্ষেত্রে এক নব চেতনা দেখা দিয়েছিল। তিনি তার গ্রন্থে ইংল্যান্ডে নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া দেখালেন। পরিবর্তিত অবস্থায় সমাজে আবির্ভাব ঘটল এক নতুন শ্রেণির, যারা ভূসম্পত্তি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কলকারখানার দিকে মনোযোগ দিলেন। তারা অনুভব করলো যে, শিল্পক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতার প্রয়োজন। তিনি অর্থনীতির তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে ভূমিবাদীদের ন্যায় কৃষির ওপর কোন জোর দিলেন না। তিনি আলোকপাত করেন, কীভাবে যাবতীয় শিল্প প্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া যায়। তিনি মনে করেন, শ্রমিক ও মালিক উভয়ের স্বার্থ কিছুতেই এক নয়। অর্থাৎ পরস্পর বিরোধী। মালিকের সংখ্যা কম। কাজেই তারা সহজেই একতাবদ্ধ হতে পারে। অপরপক্ষে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তাই তারা একতাবদ্ধ হতে পারে না। মালিকদের মধ্যে অনেক সময় গোপন চুক্তি হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরী কী পরিমাণ হতে পারে অনেক সময় তারা ঠিক করে। যদি মজুরীর পরিমাণ হ্রাস করা হয় তবে শ্রমিকেরা ঘোর আপত্তি জানায়। তাঁরা ভীষণ অশান্তি সৃষ্টি করে। এরূপ অবস্থায় মালিক পক্ষ বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। শ্রমিকদের এমন কোন সঞ্চিত অর্থ থাকে না যে, যার ওপর নির্ভর করে তাঁরা আন্দোলন চালাতে পারে। কাজেই জীবিকার জন্য বাধ্য হয়ে পুনরায় মালিকদের দ্বারস্থ হয়। এভাবে শ্রমিকদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।
সমসাময়িককালে ইংল্যান্ডে আরো কিছু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের জন্ম হয়। তাদের মধ্যে টমাস রবার্ট ম্যালথাস, ডেভিড রিকার্ডো অন্যতম। অর্থনীতিতে এঁদের অবদানও কম নয়। তবে অর্থনীতির উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে এঁরা তেমন আলোচনা করেননি। যিনি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে অর্থনীতির ভীত নাড়িয়ে দেন তিনি হলেন কার্ল মার্ক্স। এ বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ১৮১৮ সালে জার্মাানিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তদানীন্তন জার্মানির সুপ্রসিদ্ধ দার্শনিক হেগেলের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার জন্য তিনি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো চাকরি পাননি। তিনি তাঁর অতিপরিচিত এক মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেন। মেয়েটি ছিল বিখ্যাত এক ধনী পরিবারের। তারপরও তিনি জার্মানিতে কোন চাকরি পাননি। ফলে তিনি সাংবাদিক পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সেখানেও তিনি তাঁর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি। যেহেতু কার্ল মার্ক্স অতি অল্প বয়সে গণতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে নিজের সুচিন্তিত মত প্রকাশ করতেন সেহেতু রাষ্ট্রের কর্তারা তাঁর প্রতি সবসময় বিরূপ ছিল। ১৮৪৩ সালে একটি আপত্তিকর প্রবন্ধ প্রকাশ করার কারণে সরকার তাঁর পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করে। অতঃপর তিনি প্রথমে প্যারিস এবং পরে বেলজিয়াম পালিয়ে যান। পরবর্তীতে বেলজিয়াম সরকার একটি আপত্তিকর প্রবন্ধের কারণে তাঁকে বহিষ্কার করে। বেলজিয়াম থেকে তিনি আবার জার্মানিতে ফিরে আসেন। ১৮৪৮ সালে দেশে ফিরে তিনি সেই বছর বিপ্লবে যোগদান করেন। এ অপরাধে জার্মান সরকার তাঁকে জার্মানি থেকে বহিষ্কার করে। ১৮৪৯ সালে তিনি লন্ডন গমন করেন। জীবনের শেষ ৩৪ বছর তিনি এখানে কাটিয়ে দেন। এ শেষ ৩৪ বছর মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে কোনো রকমে অতি কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করেন। জীবনের এত দুর্দশায় তাঁর প্রথম সন্তান মারা যায়। সন্তানের মৃত্যুস্মৃতি তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। জীবিকার অন্বেষায় তিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ালেও ভৃত্যটি তাঁকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। আমৃত্যু তাঁর সাথে ছিল। জীবনের শেষ ৩৪ বছর এক নাগাড়ে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বসে বসে তিনি অধ্যয়ন করেন। আর এ সময়ে তাঁর সারা জীবনের চিন্তাধারার জাল বুনে একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম দেয়া হয় ্তুউঅঝ ঈঅচওঞঅখ্থ. এ গ্রন্থটি প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে সারা বিশ্বব্যাপী এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ্তুউঅঝ ঈঅচওঞঅখ্থ এ তিনি সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস এবং পুঁজিবাদকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন। তিনি এত জোরালো ভাষায় পুঁজিবাদকে আক্রমণ করেন যে, বস্তুত পুঁজিবাদের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। তাঁর এ গ্রন্থের প্রভাবে সমগ্র পৃথিবীর কোনো না কোনো অংশে এত বিশাল ঝড়-ঝঞ্ঝার শুরু হয় যে, ঐসব দেশের দীর্ঘদিনের ইতিহাস সম্পূর্ণ উল্টে যায়। তিনি প্রমাণ করেন যে, প্রত্যেক মতবাদের পিছনে লুকিয়ে আছে শ্রেণি স্বার্থ। সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক দ্বন্দ্ব, মতবাদ, নীতিবাক্য, রাজনীতি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে শ্রেণিস্বার্থ। শ্রেণিস্বার্থ ব্যতীত কোনো জিনিস দ্বারা এটা প্রভাবিত হয় না। এজন্য তিনি বলেছেন, ‘এ পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস, শ্রেণিস্বার্থের ইতিহাস। অতএব মানব জাতির ইতিহাস হল শ্রেণিস্বার্থের ধারাবাহিক বিবরণ। তিনি আরো মনে করেন- আদিকালে সমাজ ছিল সাম্য। তখন লোকে যা উৎপাদন করতো তা ভোগ করতো। ক্রমান্বয়ে উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হতে লাগল। কিন্তু উৎপাদনের যন্ত্রগুলো চলে গেল পুঁজিপতিদের হাতে। আদিকালে সকল জমির মালিক ছিল জনসাধারণ। পরবর্তীতে জমিদারেরা তা করায়ত্ত করল। জমিদার ও পুঁজিপতিগণ অর্থের বিনিময়ে অথবা বল প্রয়োগে পুঁজি ও সম্পদের মালিক হয়ে বসে। এ অবস্থায় মজুর ও চাষীর স্বাধীনতা লোপ পায়। যখনই জনসাধারণ পুঁজিপতিদের অধীনে চাকরি নিয়ে শ্রমিকে রূপান্তর হয় তখনই শ্রমিক শ্রেণিদের শোষণ করতে আরম্ভ করে। অতএব, পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব একটি চিরন্তন ব্যাপার। এভাবে কার্ল মার্ক্স শ্রমভিত্তিক মূল্যতত্ত্বের ব্যাখ্যা যেমন প্রদান করেন তেমনি উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বও প্রদান করেন। এ তত্ত্বগুলো অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক,
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।